পূর্ব রণাঙ্গন (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ)

পূর্ব রণাঙ্গন হল ২য় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনসমূহের একটি যেখানে একপক্ষে ছিল অক্ষশক্তির সদস্যসমূহ ও তাদের সহযোগী ফিনল্যান্ড এবং অপরপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড এবং মিত্রবাহিনীর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়; এই যুদ্ধ মধ্য ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ, উত্তর-পূর্ব ইউরোপ, বাল্টিক অঞ্চল এবং বলকান অঞ্চল জুড়ে সংঘটিত হয়; যুদ্ধের সময়কাল ছিল ১৯৪১ সালের ২২এ জুন থেকে ১৯৪৫ সালের ৯ই মে পর্যন্ত। এই যুদ্ধকে প্রাক্তন সোভিয়েত ও আধুনিক রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে "মহান দেশাত্মবোধের যুদ্ধ" (রুশ: Великая Отечественная война,Velikaya Otechestvennaya Voyna) বলা হয়, অপরদিকে জার্মানির দৃষ্টিকোণ থেকে একে বলা হয় "পূর্ব রণাঙ্গন" (জার্মান: die Ostfront),[৪] অথবা অন্যান্যদের দৃষ্টিকোণ থেকে একে বলা হয় জার্মান-সোভিয়েত যুদ্ধ[৫]

পূর্ব রণাঙ্গন
মূল যুদ্ধ: ২য় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয় রণাঙ্গন

উপরে বাঁ দিক থেকে (ঘড়ির কাঁটার দিকে আবর্তিত): বার্লিনের আকাশে সোভিয়েত ইল-২ স্থল আক্রমণ বিমান; কুর্স্কের যুদ্ধে জার্মান টাইগার-১ ট্যাংক বহর; পূর্ব রণাঙ্গনে জার্মান স্টুকা বোমারু বিমান, ডিসেম্বর, ১৯৪৩ সাল; ইউক্রেনের ইভানহোরোডে জার্মান হানাদার বাহিনী কর্তৃক ইহুদিদের হত্যা; উইলহেম কাইটেল জার্মানদের আত্মসমর্পণ দলিলে সাক্ষর করছেন; স্টালিনগ্রাডের যুদ্ধে সোভিয়েত সৈন্যগণ
তারিখ২২শে জুন, ১৯৪১ – ২৫শে মে, ১৯৪৫
(৩ বছর, ১১ মাস, ৩ দিন)[৩]
অবস্থান
জার্মানির পূর্বে অবস্থিত ইউরোপের অঞ্চলসমূহ: মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ, শেষ পর্যায়ে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া
ফলাফল

সোভিয়েত বিজয়

  • ৩য় রাইখের পতন
  • মিত্রবাহিনী কর্তৃক জার্মানি দখল
  • স্নায়ু যুদ্ধের সূত্রপাত এবং পূর্ব ব্লক ও লৌহ-পর্দা (Iron Curtain)-এর সৃষ্টি
  • গ্রীক গৃহযুদ্ধের সূচনা
অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
  • সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্বে মধ্য ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ, উত্তর-পূর্ব ইউরোপ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ চলে আসে; বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, পূর্ব জার্মানিসহ অন্য কতিপয় রাষ্ট্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক সোভিয়েত-পন্থী পুতুল সমাজতান্ত্রিক সরকার স্থাপন।
  • ফেডেরাল যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
  • জার্মানির দ্বিধাবিভক্তি
  • পোলান্ডের সীমান্তে পরিবর্তন
  • বিবাদমান পক্ষ
    অক্ষশক্তি:
    •  জার্মানি[১]
    •  রোমানিয়া (১৯৪৪ সাল পর্যন্ত)
    •  ইতালি (১৯৪৩ সাল পর্যন্ত)
    • টেমপ্লেট:দেশের উপাত্ত হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য[২]
    •  বুলগেরিয়া (১৯৪৪ সালের ৫-৯ সেপ্টেম্বর)

    সহ-যুধ্যমান:
    মিত্রশক্তি:
    প্রাক্তন অক্ষশক্তির সদস্য অথবা সহ-যুধ্যমান:

    জলপথ ও আকাশপথে সহায়তা:
    সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
    • নাৎসি জার্মানি অ্যাডলফ হিটলার (সর্বাধিনায়ক)
    • নাৎসি জার্মানি ওয়াল্টার ফন ব্রকিচ্‌
    • নাৎসি জার্মানি ফেডোর ফন বক
    • নাৎসি জার্মানি ফ্রাঞ্জ হ্যালডার
    • নাৎসি জার্মানি কার্ট জাইট্‌জ্‌লার
    • নাৎসি জার্মানি ফ্রেডরিক পলাস
    • নাৎসি জার্মানি এরিক ফন ম্যানস্টাইন
    • নাৎসি জার্মানি হাইঞ্জ গুডেরিয়ান
    • নাৎসি জার্মানি গান্টার ফন ক্ল্যুগ
    • নাৎসি জার্মানি গার্ড ফন রুনস্টেড
    • নাৎসি জার্মানি ম্যাক্সিমিলান ফন ওয়েইক্স
    • নাৎসি জার্মানি হার্মান গোরিং
    • নাৎসি জার্মানি রবার্ট রিটার ফন গ্রাইম
    • রোমানীয় রাজ্য আয়ন অ্যান্টোনেস্কু
    • ইতালির রাজত্ব (১৮৬১–১৯৪৬) বেনিতো মুসোলিনি
    • হাঙ্গেরিমিক্লোস হোর্থি
    • হাঙ্গেরিফেরেন্‌ক জালাসি
    • বুলগেরিয়ার রাজত্ব ৩য় বরিস
    • স্লোভাকিয়া জোসেভ টিসো
    • ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্র আন্‌তে পাভেলিচ
    • ফিনল্যান্ড রিস্তো রাইটি
    • ফিনল্যান্ড সি.জি.ই. ম্যানারহাইম
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন জোসেফ স্টালিন (সর্বাধিনায়ক)
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন জর্জি জুকভ
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্লিমেন্ট ভোরোশিলভ
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন বরিস শাপোশনিকভ
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন আলেক্সান্ডার ভাসিলেভ্‌স্কি
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন সেমিয়োন টিমোশেঙ্কো
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন আলেক্সেই অ্যান্তোনভ
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন ইভান কোনেভ
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিওদোর টোলবুখিন
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন ইভান বাগ্রামিয়ান
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন কনস্টান্টিন রোকোসভ্‌স্কি
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন নিকোলাই ভাটুটিন
    • সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাসিলি চুইকভ
    • গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় যুগোস্লাভিয়া জোসিপ ব্রোজ টিটো
    • পোল্যান্ড জিগমুন্ট বের্লিং
    • চেকোস্লোভাকিয়া লুডভিক স্‌ভোবোদা
    • রোমানীয় রাজ্য ১ম মাইকেল অব রোমানিয়া
    • রোমানীয় রাজ্য নিকোলাই রাডেস্কু
    • কিমোন জর্জিয়েভ
    শক্তি
    • ১৯৪১
      ৩৭,৬৭,০০০ জন সৈন্য
    • ১৯৪২
      ৩৭,২০,০০০ জন সৈন্য
    • ১৯৪৩
      ৩৯,৩৩,০০০ জন সৈন্য
    • ১৯৪৪
      ৩৩,৭০,০০০ জন সৈন্য
    • ১৯৪৫
      ১৯,৬০,০০০ জন সৈন্য
    • ১৯৪১
      (সম্মুখ ভাগে) ২৬,৮০,০০০ জন সৈন্য
    • ১৯৪২
      (সম্মুখ ভাগে) ৫৩,১৩,০০০ জন সৈন্য
    • ১৯৪৩
      (সম্মুখ ভাগে) ৬৭,২৪,০০০ জন সৈন্য
    • ১৯৪৪
      ৬৮,০০,০০০ জন সৈন্য
    • ১৯৪৫
      ৬৪,১০,০০০ জন সৈন্য
    হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
    ৫১ লক্ষ নিহত
    ৪৫ লক্ষ আটক
    ৮৭-১০০ লক্ষ নিহত
    ৪১ লক্ষ আটক

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গনে গঠিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে মানব ইতিহাসের বৃহত্তম কয়েকটি সামরিক সংঘাত অন্তর্ভুক্ত।[৬] অভূতপূর্ব ভয়াবহতা, ঢালাও ধ্বংসযজ্ঞ, গণহারে নির্বাসন, তদুপরি সংঘাত, অনাহার, রোগ-ব্যাধি এবং গণহত্যার কারণে অগণিত প্রাণহানীর জন্যে এসকল যুদ্ধের পরিচায়ক। প্রায় সবকয়টি নির্মূল শিবির, মৃত্যু যাত্রা, নাৎসি নির্মিত ঘেটো, ইহুদি গনহত্যার অধিকাংশের মূলকেন্দ্র ছিল এই পূর্ব রণাঙ্গন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোট ৭ থেকে ৮.৫ কোটি নিহতের মধ্যে এই পূর্ব রনাঙ্গনেই নিহত হয় প্রায় ৩ কোটি মানুষ।[৭] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয় ক্ষেত্রে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে এই পূর্ব রণাঙ্গনে সংঘটিত যুদ্ধসমূহ; এবং পরিশেষে নাৎসি জার্মানি ও অক্ষশক্তির পতনের মূল কারণও এই পূর্ব রণাঙ্গন।[৮][৯][১০]

    এ রণাঙ্গনে প্রধান দুই প্রতিপক্ষ ছিল জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবং তাদের পক্ষে নিজ নিজ মিত্ররা। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পূর্ব রণাঙ্গনের কোন সামরিক অভিযানে অংশ নেয়নি, তবুও উভয় রাষ্ট্রই সোভিয়েত ইউনিয়নকে রসদ, তেল ইত্যাদি সরবরাহ করে যুদ্ধের মোড় ঘোরাতে ভূমিকা রাখে। ফিনিশ-সোভিয়েত সীমান্তে এবং মুরমান্‌স্ক অঞ্চলে জার্মান-ফিনিশ যৌথ আক্রমণ পূর্ব রণাঙ্গনের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়াও সোভিয়েত-ফিনিশ যুদ্ধও পূর্ব রণাঙ্গনের মধ্যে পড়ে।

    পটভূমিসম্পাদনা

    ১ম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) ফলাফল নিয়ে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই অসন্তুষ্ট ছিল। ব্রেস্ট-লিটোভ্‌স্কের চুক্তি (মার্চ, ১৯১৮) অনুযায়ী সোভিয়েত রাশিয়া পূর্ব ইউরোপে বিস্তর ভূখণ্ড হারায়, এতে পেট্রোগ্রাডে বলশেভিকগণ জার্মানদের দাবি মেনে নেয় এবং অক্ষশক্তির কাছে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, ফিনল্যান্ড এবং অন্যান্য অঞ্চলসমূহের কর্তৃত্ব হস্তান্তর করে দেয়। আবার জার্মানি ১ম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে (নভেম্বর, ১৯১৮) এবং ভার্সাই নগরীতে অনুষ্ঠিত প্যারিস শান্তি সম্মেলনে(১৯১৯) গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উল্লিখিত ভূখণ্ডসমূহ স্বাধীন হয়ে যায়। এ সম্মেলন চলাকালে সোভিয়েত রাশিয়া রুশ গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল, এবং মিত্রবাহিনী বলশেভিক সরকারকে অনুমোদন না দেয়াতে সোভিয়েত রাশিয়ার কোন প্রতিনিধি প্যারিস সম্মেলনে অংশ নিতে পারেনি।[১১]

    ১৯৩৯ সালের ১১ আগস্ট অ্যাডলফ হিটলার জাতিপুঞ্জের কমিশনার কার্ল জ্যাকব বুর্কহার্টের নিকটে তার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সংকল্পের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন:

    আমি যা কিছু করার অঙ্গীকার নেই, সবকিছুরই উদ্দেশ্য রাশিয়ার বিরোধিতা করা। পশ্চিমা বিশ্ব যদি এতই নির্বোধ আর অন্ধ হয়ে থাকে যে এটি তারা বোধগম্য করতে ব্যর্থ হয়, তবে আমি বাধ্য হব রুশদের সাথে একটি সমঝোতায় যেতে, তারপর পশ্চিমা শক্তিদেরকে আমি আগে পরাজিত করব, অতঃপর তারা পরাস্ত হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াব এবং তাদের বিরুদ্ধে আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করব। ইউক্রেনকে আমার দরকার, যাতে তারা আমাদের অনাহারে রাখতে না পারে, যা তারা শেষ যুদ্ধে করেছিল।[১২]

    "মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি" ছিল জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সাক্ষরিত একটি অনাগ্রাসন চুক্তি, যা সাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালের আগস্টে। চুক্তিটির একটি গোপনীয় ধারা ছিল যার উদ্দেশ্য ছিল মধ্য ইউরোপকে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ভাগাভাগি করতঃ ১ম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী স্থিতাবস্থায় নিয়ে যাওয়া। ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়ার কর্তৃত্ব পাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, অপরদিকে পোল্যান্ড ও রোমানিয়া দু'পক্ষের মধ্যে ভাগাভাগি হবে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আরেকটি কারণ হল "জার্মান-সোভিয়েত সীমান্ত ও বাণিজ্য চুক্তি" যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানিকে পূর্ব ইউরোপ আক্রমণের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ও কাঁচামাল সরবরাহ করে।[১৩]

    ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করার মাধ্যমে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। এবং ১৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে আক্রমণ চালায়, ফলে পোল্যান্ড জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও লিথুয়ানিয়ার মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরপর অতি শীঘ্রই সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ডকে বিস্তর ভূখণ্ড ছেড়ে দেয়ার দাবি করে বসে। ফিনল্যান্ড তাদের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করলে ১৯৩৯ সালের ৩০ নভেম্বর সোভিয়েতরা ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে, যা "শীতকালীন যুদ্ধ" নামে পরিচিত হয়, এই দুঃসাধ্য যুদ্ধের সমাপ্তি হয় ১৯৪০ সালের ১৩ই মার্চ শান্তিচুক্তির মাধ্যমে, যে চুক্তি অনুযায়ী ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতা বজায় থাকে তবে তারা তাদের পূর্বাঞ্চলের কারেলিয়া এলাকা সোভিয়েতদেরকে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়।[১৪]

    ১৯৪০ সালের জুন মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন তিনটি বাল্টিক রাষ্ট্র (এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া) অবৈধভাবে আক্রমণ ও দখল করে নেয়।[১৪] "মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি" বাহ্যত সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিরাপদে বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ ও রোমানিয়ার উত্তর-পূর্বাংশ দখল করার অনুমতি দেয় (বুকোভিনা ও বেসারাভিয়া, জুন-জুলাই, ১৯৪০)। যদিও হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের ঘোষণা দেন এই যুক্তিতে যে, বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ ও রোমানিয়ার ভূখণ্ড দখলের মাধ্যমে সোভিয়েতরা জার্মানির সাথে স্থাপিত তাদের চুক্তি ভঙ্গ করেছে। মস্কো তাদের দখলকৃত রোমানিয়ান ভূখণ্ড ইউক্রেনিয়ান ও মলডাভিয়ান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র- এই দুই ভাগে বিভক্ত করে।

    উভয়পক্ষের মতাদর্শসম্পাদনা

    জার্মান মতাদর্শসম্পাদনা

    অ্যাডলফ হিটলার তার আত্মজীবনী "মেইন ক্যাম্প্‌ফ" (১৯২৫)-এ Lebensraum বা "জীবনযাপনের স্থান" ধারণা পোষণ করেন: তার মতে জার্মানদের বসবাসের জন্যে পূর্ব ইউরোপে, বিশেষ করে রাশিয়ায় নতুন ভূখণ্ড অধিকার করা প্রয়োজন।[১৫] তিনি এসকল স্থানে জার্মানদের বসতি স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন, কেননা নাৎসি মতবাদ মতে জার্মানরা "মনিব জাতি" ("master race") হিসেবে গণ্য, তাই অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে হয় হত্যা অথবা সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেয়া হবে, অবশিষ্ট যারা থাকবে তারা জার্মানদের দাসত্ব করবে।[১৬] ১৯১৭ সালেই হিটলার রুশদেরকে 'নিকৃষ্ট' বলে উল্লেখ করেন, তার বিশ্বাস ছিল বলশেভিক আন্দোলনের ফলে ইহুদিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ স্লাভদের ওপর কর্তৃত্ব পেয়ে গেছে, যারা, হিটলারের মতে, নিজেদের নেতৃত্ব দেয়ার অযোগ্য, বরং তাদের ইহুদি প্রভুদের আজ্ঞাবহ।[১৭]

    নাৎসিদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, (যার মধ্যে অন্যতম হেনরিক হিমলার)[১৮] সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধকে দেখেন '''নাৎসিবাদ''' ও ইহুদি বলশেভিকবাদের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে, এবং এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা জার্মান "উচ্চতর মানবগোষ্ঠী"র আঞ্চলিক কর্তৃত্ব স্থাপন করবে, যারা নাৎসিদের বিশ্বাস অনুযায়ী "আর্য জাতি" এবং "মনিব গোষ্ঠী", যারা স্লাভিক "নিকৃষ্ট জাতি"কে অপসরণ করবে।[১৯] ওয়েরমাক্‌ট (জার্মান সেনাবাহিনী) সেনা কর্মকর্তারা তাদের অধীনস্থ সৈন্যদের নির্দেশ দিতেন এমন মানুষদের আক্রমণ করতে যারা "ইহুদি বলশেভিক নিকৃষ্ট মানবগোষ্ঠী", "মঙ্গল বর্বর", "এশীয় বন্যাধারা" বা "লোহিত জানোয়ার"।[২০] অধিকাংশ জার্মান সৈন্য এ যুদ্ধকে নাৎসি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখত, সোভিয়েতদেরকে তারা নিকৃষ্ট জাতি বলে মনে করত।[২১]

    হিটলার এই যুদ্ধকে বর্ণবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি একে বলেন "নির্মূলীকরণের যুদ্ধ" (Vernichtungskrieg), যা ছিল একইসাথে একটি আদর্শগত ও বর্ণবাদী যুদ্ধ। পূর্ব ইউরোপের জন্য নাৎসিদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কেন্দ্রে ছিল তাদের গণহত্যা কর্মসূচি- "জেনারেলপ্ল্যান ওস্ট" (Generalplan Ost)। মধ্য ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগোষ্ঠীসমূহকে পশ্চিম সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে এবং জার্মানদের ক্রীতদাসে পরিণত করে কার্যতঃ নির্মূল করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের; দখলকৃত অঞ্চলসমূহে জার্মান অথবা "জার্মানায়িত" জনগোষ্ঠীর স্থায়ী বসতি স্থাপনের চিন্তা ছিল।[২২] তদুপরি নাৎসিদের পরিকল্পনা ছিল মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের সুবৃহৎ ইহুদি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া,[২৩] যা তারা ইহুদি গণহত্যা কর্মসূচির ("হলোকাস্ট") দ্বারা বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা চালায়।[২৪]

    ১৯৪১ সালে কিয়েভের যুদ্ধে তাদের প্রাথমিক সাফল্যের পর, হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামরিকভাবে দূর্বল ভাবতে শুরু করেন, এবং এসময়ই তাদেরকে আক্রমণ ও দখল করে নেয়ার উপযুক্ত সময় বলে ভাবতে থাকেন। ৩ অক্টোবর বার্লিনের "স্পোর্টপালাস্ট" অঙ্গনে তিনি যে ভাষণ দেন তাতে তিনি উল্লেখ করেন, "আমাদের শুধু লাথি মেরে তাদের দরজা ভাঙতে হবে, তাতেই তাদের পচে যাওয়া পুরো কাঠামো ধসে পড়বে।"[২৫] সুতরাং, জার্মানি আশা করে তাদের আরেকটি আকস্মিক আক্রমণ "ব্লিট্‌জক্রিগ" পরিচালনা করাই সোভিয়েত ইউনিয়ন দখলের জন্য যথেষ্ট, এবং তারা কোন প্রকার দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ পরিকল্পনা করার প্রয়োজন মনে করেনি। কিন্তু ১৯৪৩ সালে স্তালিনগ্রাডের যুদ্ধে সোভিয়েতদের কাছে জার্মানরা পরাস্ত হলে তাদের সামরিক পরিস্থিতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। অতঃপর নাৎসি প্রচার ব্যবস্থা এই প্রচারণা চালাতে থাকে যে জার্মানরা ইউরোপের পশ্চিমা সভ্যতাকে "বলশেভিক বর্বরদের" ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা করছে।

    সোভিয়েত চিন্তাধারাসম্পাদনা

    সেমিয়োন টিমোশেঙ্কো এবং জর্জি জুকভ, ১৯৪০ সালে

    ১৯৩০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন জোসেফ স্টালিনের নেতৃত্বে ব্যপক শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লাভ করে। স্টালিনের মূলনীতি "এক রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র" ১৯২৯ সাল থেকে জাতীয়ভাবে শুরু হওয়া "৫ বছর মেয়াদী পরিকল্পনার" মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। এই নীতির ফলে সোভিয়েত কর্মসূচিতে আদর্শগত পরিবর্তন আনে, যার ফলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট বিপ্লব থেকে সোভিয়েতরা সরে আসে এবং এর পরিণতিতে ১৯৪৩ সালে "কমিন্টার্ন" (৩য় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংগঠন)-এর বিলুপ্তি ঘটে। ১৯২৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়া প্রথম "৫ বছরব্যপী কর্মসূচি" মোতাবেক সোভিয়েতগণ নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ করে। যদিও সামরিক বাহিনীসমূহ সোভিয়েতদের শিল্পায়নের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় ১৯৩০-এর দশকের শেষভাগে, দ্বিতীয় "৫ বছরব্যপী কর্মসূচির" সময়।[২৬]

    ১৯৩৬ সালে স্পেনে সাধারণ নির্বাচনের সময় বহু কমিউনিস্ট নেতাগণ স্পেনের রাজনৈতিক দল "পপুলার ফ্রন্ট" শাসিত স্পেনীয় ২য় প্রজাতন্ত্র সরকার গঠনে অংশগ্রহণ করেন, তবে এ সরকার গঠনের কয়েক মাসের মধ্যেই ডানপন্থী সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহে ১৯৩৬-১৯৩৯ সালের স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে। এ যুদ্ধ শীঘ্রই বদলি যুদ্ধ বা "প্রক্সি" যুদ্ধের (Proxy war) রূপ নেয়, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের বামপন্থী সেচ্ছাসেবকের দল জড়িয়ে পড়ে, যারা প্রধানত কমিউনিস্টপন্থী[২৭] "স্পেনীয় ২য় প্রজাতন্ত্রের" পক্ষাবলম্বন করে;[২৮] অপরদিকে নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিবাদী ইতালি এবং পর্তুগীজ প্রজাতন্ত্র জেনারেল ফ্রানচিস্কো ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী সেনাবাহিনী- "স্পেনীয় জাতীয়বাদী"দের পক্ষাবলম্বন করে।[২৯] এই যুদ্ধটি জার্মান সেনাবাহিনী "ওয়েরমাক্‌ট" এবং সোভিয়েত "লাল ফৌজ"-এর রণকৌশল ও যুদ্ধাস্ত্রসমূহ পরীক্ষার জন্যে একটি উপযুক্ত পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা পরবর্তীতে বৃহত্তর পরিসরে ২য় বিশ্বযুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছিল।

    নাৎসি জার্মানি, যারা ছিল কট্টর কমিউনিস্ট-বিরোধী, তাদের আদর্শিক অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে ১৯৩৬ সালের ২৫ নভেম্বর, যখন তারা জাপানের সাথে "কমিন্টার্ন বিরোধী চুক্তি"-তে সাক্ষর করে।[৩০] ফ্যাসিবাদী ইতালিও এর এক বছর পর এই চুক্তিতে সাক্ষর করে।[২৮][৩১] ১৯৩৮ সালে জার্মানদের কর্তৃক অস্ট্রিয়া দখল এবং ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়া দখল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ইউরোপে একটি সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা অসম্ভব,[৩২] যে নীতির পরিকল্পনা উত্থাপন করেছিলেন ম্যাক্সিম লিটভিনভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।[৩৩][৩৪] তদুপরি সোভিয়েতদের সাথে পূর্ণমাত্রার একটি "জার্মান-বিরোধী রাজনৈতিক ও সামরিক মৈত্রী চুক্তিতে" সাক্ষর করতে ব্রিটিশ ও ফরাসি সরকার ইতস্তত করার[৩৫] ফলশ্রুতিতে সোভিয়েত ও জার্মানির মধ্যকার "মোলোটভ-রিবেনট্রপ" চুক্তি সাক্ষরিত হয় (আগস্ট, ১৯৩৯)।[৩৬] পৃথকভাবে সাক্ষরিত হওয়া "ত্রিপক্ষীয় চুক্তি", যা পরবর্তীতে তিনটি অক্ষশক্তিতে (জার্মানি, ইতালি ও জাপান) রূপ নিয়েছিল, তা সাক্ষরিত হয়েছিল কমিউনিস্ট-বিরোধী চুক্তি সাক্ষরিত হবারও চার বছর পরে।

    সামরিক শক্তিসম্পাদনা

    ১৯৪১ সালের মে/জুন মাসে ইউরোপের পরিস্থিতি, "অপারেশন বারবারোসা" সংঘটিত হবার ঠিক পূর্বে।

    এ যুদ্ধের একপক্ষে ছিল নাৎসি জার্মানি, তাদের মিত্রসমূহ ও ফিনল্যান্ড এবং অপরপক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এর মিত্রগণ। সংঘাত প্রথম শুরু হয় ১৯৪১ সালের ২২শে জুন, "অপারেশন বারবারোসা"-এর পরিচালনার মাধ্যমে, যখন অক্ষশক্তির বাহিনীসমূহ "জার্মান-সোভিয়েত অনাগ্রাসন চুক্তিতে" বর্ণিত সীমান্ত পার হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। যুদ্ধের সমাপ্তি হয় ১৯৪৫ সালের ৯ই মে, যখন জার্মান সামরিক বাহিনী বার্লিনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে, এ যুদ্ধটি ছিল সোভিয়েত "লাল ফৌজ" পরিচালিত একটি কৌশলগত অভিযান।

    জার্মান যুদ্ধ প্রচেষ্টায় যেসকল রাষ্ট্র সৈন্য ও অন্যান্য রসদ সরবরাহ করে সহায়তা করেছিল তাদের অক্ষশক্তির অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়- প্রধানত রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, নাৎসি-সমর্থনকারী স্লোভাকিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া। সোভিয়েত-বিরোধী ফিনল্যান্ড, যাদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন "শীতকালীন যুদ্ধ" পরিচালনা করেছিল, তারাও জার্মানদের পক্ষাবলম্বন করে। "ওয়েরমাক্‌ট" বাহিনীকে আরো সহায়তা করে পশ্চিম ইউক্রেন ও বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহের কমিউনিস্ট-বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল "স্পেনীয় নীল সৈন্যবিভাগ", যাদেরকে যুদ্ধে পাঠান স্পেনীয় সৈরাচারী শাসক ফ্রানচেস্কো ফ্রাঙ্কো, যিনি অক্ষশক্তির প্রতি তার আনুগত্যকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন।[৩৭]

    অপরপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন "ওয়েরমাক্‌ট" বাহিনী অধিকৃত মধ্য ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহে কমিউনিস্ট-পন্থীদের সহায়তা করে থাকে, বিশেষ করে স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড এবং যুগোস্লাভিয়ায়। তাছাড়া, পূর্ব-পোল্যান্ডে সশস্ত্র বাহিনীসমূহকে, বিশেষ করে ১ম ও ২য় পোলিশ সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবারাহ করে সোভিয়েত লাল ফৌজ, এবং এক পর্যায়ে তারা লাল ফৌজের পাশাপাশি যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করে। এছাড়া "স্বাধীন ফরাসি সেনাবাহিনী"র "৩য় যোদ্ধাদল" (Groupe de Chasse 3) লাল ফৌজের পাশাপাশি যুদ্ধ করে, যা স্বাধীন ফরাসিদের নেতা চার্লস ডি গলের অঙ্গীকার পূর্ণ করে, যিনি ভেবেছিলেন ফরাসিদের কর্তব্য হবে সকল রণাঙ্গনেই ভূমিকা পালন করা।

    যুদ্ধরত বাহিনীসমূহের তুলনামূলক সামরিক শক্তি, পূর্ব রণাঙ্গন, ১৯৪১-১৯৪৫ সাল[৩৮][৩৯][৪০]
    তারিখঅক্ষশক্তিসোভিয়েত বাহিনী
    ২২ জুন, ১৯৪১৩০,৫০,০০০ জার্মান, ৬৭,০০০ (উত্তর নরওয়ে); ৫,০০,০০০ ফিন; ১,৫০,০০০ রোমানীয়
    মোট: ৩৭,৬৭,০০০ পূর্বে (মোট জার্মান সেনাবাহিনীর ৮০%)
    ২৬,৮০,০০০ জন সৈন্য, (পশ্চিম সামরিক এলাকাসমূহে নিযুক্ত), ৫৫,০০,০০০ জন সৈন্য (মোট); ১,২০,০০,০০০ জন যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত সংরক্ষিত বাহিনী
    ৭ জুন, ১৯৪২২৬,০০,০০০ জার্মান, ৯০,০০০ (উত্তর নরওয়ে); ৬,০০,০০০ রোমানীয়, হাঙ্গেরীয় ও ইতালীয়
    মোট: ৩৭,২০,০০০ পূর্বে (মোট জার্মান সেনাবাহিনীর ৮০%)
    ৫৩,১৩,০০০ (সম্মুখ সমরে); ৩,৮৩,০০০ (আহত, হাসপাতালে)
    মোট: ৯৩,৫০,০০০
    ৯ জুলাই, ১৯৪৩৩৪,০৩,০০০ জার্মান, ৮০,০০০ (উত্তর নরওয়ে); ৪,০০,০০০ ফিন; ১,৫০,০০০ রোমানীয় ও হাঙ্গেরীয়
    মোট: ৩৯,৩৩,০০০ পূর্বে (মোট জার্মান সেনাবাহিনীর ৬৩%)
    ৬৭,২৪,০০০ (সম্মুখ সমরে); ৪,৪৬,৪৪৫ (হাসপাতালে);
    মোট: ১,০৩,০০,০০০
    ১ মে, ১৯৪৪২৪,৬০,০০০ জার্মান, ৬০,০০০ (উত্তর নরওয়ে); ৩,০০,০০০ ফিন; ৫,৫০,০০০ রোমানীয় ও হাঙ্গেরীয়
    মোট: ৩৩,৭০,০০০ পূর্বে (মোট জার্মান সেনাবাহিনীর ৬২%)
    ৬৪,২৫,০০০
    ১ জানুয়ারি, ১৯৪৫২২,৩০,০০০ জার্মান; ১,০০,০০০ হাঙ্গেরীয়
    মোট: ২৩,৩০,০০০ পূর্বে (মোট জার্মান সেনাবাহিনীর ৬০%)
    ৬৫,৩২,০০০ (৩,৬০,০০০ পোলিশ, রোমানীয়, বুলগেরীয় ও চেক)
    ১ এপ্রিল, ১৯৪৫১৯,৬০,০০০ জার্মান
    মোট: ১৯,৬০,০০০ (মোট জার্মান সেনাবাহিনীর ৬৬%)
    ৬৪,১০,০০০ (৪,৫০,০০০ পোলিশ, রোমানীয়, বুলগেরীয় ও চেক)

    উল্লিখিত গণনায় জার্মান সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত সকল সৈন্যকে গণ্য করা হয়েছে- দায়িত্বরত জার্মান সেনাবাহিনী ("ওয়েরমাক্‌ট")-এর সাধারণ সদস্য "হীর", বিশেষ "ওয়াফেন এস.এস." সদস্য, বিমান বাহিনী "লুফ্‌টওয়াফ"-এর অধীন স্থলবাহিনীর সদস্য, নৌবাহিনী ও উপকূল রক্ষী গোলন্দাজ বাহিনীর সদস্য এবং নিরাপত্তা কর্মী সকলেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।[৪১][৪২] ১৯৪০ সালের বসন্তে, জার্মানি ৫৫,০০,০০০ সৈন্য মোতায়েন রাখে।[৪৩] সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সময় "ওয়েরমাক্‌ট" বাহিনীতে ৩৮,০০,০০০ জন সাধারণ সদস্য "হীর", ১৬,৮০,০০০ "লুফ্‌টওয়াফ" সদস্য, ৪,০৪,০০০ নৌবাহিনী "ক্রীগ্‌সম্যারিন" সদস্য, ১,৫০,০০০ "ওয়াফেন এস.এস." সদস্য এবং সংরক্ষিত বাহিনীতে ১২,০০,০০০ সদস্য ছিল, (তন্মধ্যে ৪,৫০,০০০ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত সংরক্ষিত সেনা, ৫,৫০,০০০ নবাগত সদস্য এবং ২,০৪,০০০ প্রশাসনিক কর্মচারী, পুলিশ, অগ্নিনির্বাপক সদস্য এবং হাসপাতাল কর্মী অন্তর্ভুক্ত ছিল)। ১৯৪১ সালে "ওয়েরমাক্‌ট" এর লোকবল ছিল ৭২,৩৪,০০০ জন সদস্য। "অপারেশন বারবারোসা"-তে জার্মানি ৩৩,০০,০০০ সাধারণ সৈন্য ও ১,৫০,০০০ ওয়াফেন এস.এস. সৈন্য প্রেরণ করে।[৪৪] এবং প্রায় ২,৫০,০০০ বিমানবাহিনী সদস্য নিযুক্ত থাকে।[৪৫]

    ১৯৪৩ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ওয়েরমাক্‌ট-এ ৬৮,১৫,০০০ সেনাসদস্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। তন্মধ্যে ৩৯,০০,০০০ জন পূর্ব ইউরোপে নিযুক্ত ছিল, ১,৮০,০০০ জন ফিনল্যান্ডে, ৩,১৫,০০০ জন নরওয়েতে, ১,১০,০০০ জন ডেনমার্কে, ১৩,৭০,০০০ জন পশ্চিম ইউরোপে, ৩,৩০,০০০ জন ইতালিতে, ৬,১০,০০০ জন বলকান অঞ্চলে নিযুক্ত থাকে।[৪৬] জেনারেল অ্যালফ্রেড জোড্‌লের প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী, ১৯৪৪ সালের এপ্রিলে "ওয়েরমাক্‌ট"-এ ৭৮,৪৯,০০০ জন সৈন্য ছিল। এর মধ্যে ৩৮,৭৮,০০০ জন পূর্ব ইউরোপে নিযুক্ত ছিল, ৩,১১,০০০ নরওয়ে-ডেনমার্কে, ১৮,৭৩,০০০ জন পশ্চিম ইউরোপে, ৯,৬১,০০০ জন ইতালিতে এবং ৮,২৬,০০০ বলকান অঞ্চলে নিযুক্ত ছিল।[৪৭] জার্মান বাহিনীসমূহের ১৫-২০% সৈন্য ছিল ভিনদেশীয় (মিত্র রাষ্ট্রসমূহ ও দখলকৃত অঞ্চলসমূহ থেকে নিযুক্ত)। জার্মানরা তাদের লোকবলের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছায় কুর্স্কের যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে, ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে: ৩৪,০৩,০০০ জন জার্মান সৈন্য, ৬,৫০,০০০ ফিনিশ, হাঙ্গেরীয়, রোমানীয় ও অন্যান্য জাতীয় সৈন্য তাদের বাহিনীতে নিযুক্ত থাকে।[৩৯][৪০]

    জার্মানি কর্তৃক ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ও বলকান দেশসমূহ দখলের পর প্রায় দুই বছর সীমান্ত এলাকাসমূহ শান্ত থাকে। হিটলার বহু আগে থেকেই সোভিয়েতদের সাথে করা চুক্তিটি ভঙ্গ করার পরিকল্পনা করছিলেন, অবশেষে তিনি সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করেন ১৯৪১ সালের বসন্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের মাধ্যমে।

    অনেক ইতিহাসবিদ বলে থাকেন স্টালিন জার্মানির সাথে যুদ্ধে যেতে ভীত ছিলেন, তিনি আশা করেননি যে জার্মানি একই সাথে উভয় রণাঙ্গনেই যুদ্ধ শুরু করবে এবং হিটলারকে যুদ্ধে প্রলুব্ধ করার কোন ইচ্ছা তার ছিল না। আবার অনেকে বলেন, স্টালিন চেয়েছিলেন জার্মানি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। আরেকটি দৃষ্টিকোণ হল, স্টালিন আশা করছিলেন ১৯৪২ সালে যুদ্ধ বাঁধুক (ততদিনে তার যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হবে) এবং যুদ্ধ যে এর আগেই আরম্ভ হতে পারে এমনটি তিনি মানতে নারাজ ছিলেন।[৪৮]

    রাশিয়ায় জার্মান পদাতিক বাহিনী, ১৯৪৩ সালের জুন মাস।

    ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ অ্যালান এস. মিলওয়ার্ড এবং এম. মেডলিকোট প্রমাণ দেখান যে, নাৎসি জার্মানি অতীতের জার্মান সাম্রাজ্যের ন্যায় দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, বরং তাদের প্রস্তুতি ছিল শুধুমাত্র একটি ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধের (ঝটিকা হামলা বা "ব্লিট্‌জক্রীগ")।[৪৯] ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড এডিসনের মতে, যদিও ১৯৪০ সাল পর্যন্ত পশ্চিমে বিজয় অর্জনের জন্য জার্মানির কাছে প্রয়োজনীয় সম্পদ ও রসদ সরবরাহ ছিল, তবুও সোভিয়েতদের সরবরাহকৃত রসদের চালানসমূহ "অপারেশন বারবারোসা" পরিচালনার জন্যে অপরিহার্য ছিল।[৫০]

    পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে জার্মানি বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করা শুরু করে এবং সীমান্তের অপরপারের তথ্য সংগ্রহের জন্যে একের পর এক পর্যবেক্ষণ বিমান প্রেরণ করতে থাকে; সোভিয়েত ইউনিয়ন এর জবাবে তাদের পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করতে থাকে, যদিও সোভিয়েতদের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা জার্মানদের মত উন্নত না হওয়ায় তাদের প্রস্তুতি জার্মানদের অপেক্ষা অনেক ধীরগতিতে হচ্ছিল। পূর্ব চীনা রেললাইনে সংঘটিত "চীন-সোভিয়েত সংঘর্ষ" কিংবা "সোভিয়েত-জাপান সীমান্ত সংঘর্ষ" যুদ্ধদ্বয়ের ন্যায় পশ্চিম সীমান্তে নিযুক্ত সোভিয়েত সেনাদেরকেও নির্দেশ দেয়া হয় "কোন উসকানি দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়া যাবে না" এবং "বিশেষ আদেশ ব্যতীত কোন আক্রমণ করা যাবে না", যে আদেশ সাক্ষরিত হয় মার্শাল সেমিয়োন টিমোশেঙ্কো এবং জেনারেল জর্জি জুকভ (স্টালিনের আদেশ অনুযায়ী)। এতে করে সোভিয়েত সেনারা শুধুমাত্র তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে গুলি চালনার অনুমতি পায় এবং জার্মান অধিকৃত অঞ্চলসমূহে আক্রমণ করার অনুমতি তাদের ছিল না। তাই জার্মানদের আকস্মিক আক্রমণ সোভিয়েত সেনা এবং তাদের নেতৃবর্গকে হতভম্ব করে দেয়।

    জার্মান আক্রমণ সম্পর্কে স্তালিন কতটা আগাম সংবাদ পেয়েছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, এবং তিনি "২২শে জুন যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই জার্মানি হামলা চালাবে" এই বার্তা পেয়েছিলেন বলে যে প্রচলিত ধারণা রয়েছে তা নিছক বানোয়াট তথ্য বলে ধারণা করা হয়। তবে কোন কোন সূত্রে এমনটা জানা যায় যে সোভিয়েত গুপ্তচরদ্বয় রিচার্ড সোর্গে এবং উইলি লেম্যান এই সংকেত পান যে ২০ অথবা ২২ জুন হামলা হতে পারে, তবে তাদের সাবধানবাণীকে আমলে নেয়া হয়নি। তাছাড়া সুইটজারল্যান্ডের "লুসি স্পাই রিং" নামক গুপ্তচর সংস্থা হামলা হবার আগাম সতর্কবাণী দেয়, খুব সম্ভব ব্রিটিশদের "সাংকেতিক বার্তা উদ্ধার" (codebreaking) কর্মসূচির সাহায্যে তারা এই আগাম সতর্কবাণী দিতে সক্ষম হয়।

    জার্মানদের রটানো গুজব দ্বারা সোভিয়েত গোয়েন্দা বাহিনী প্রতারিত হয়, তারা মস্কোকে এই ভুল সতর্কবাণী দেয় যে জার্মানরা এপ্রিল, মে এবং জুনের প্রথম দিকে আক্রমণ করবে। সোভিয়েত গোয়েন্দা বাহিনী এই রিপোর্ট দেয় যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের আগে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করবে না।[৫১] অথবা ব্রিটেন আক্রমণের সময় জার্মানরা ইউক্রেন দখলের অন্যায় দাবি করতে পারে এই ভুল তথ্যও দেয়া হয়।[৫২]

    বৈদেশিক সহায়তা ও কর্মসূচিসম্পাদনা

    ২য় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন বিমান বাহিনী ও ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কৌশলগত বিমান হামলা জার্মান শিল্পোৎপাদনকে ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং জার্মান বিমান বাহিনীকে বাধ্য করে নিজ ভূখণ্ড ও কলকারখানাসমূহ প্রতিরক্ষায় ব্যস্ত থাকতে। তাছাড়া সোভিয়েতদের বিশেষ অভিযানে সহায়তা করতে মার্কিন ও ব্রিটিশ বিমান বাহিনী পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেন নগরীতে বোমা হামলা চালায়। জার্মানি ছাড়াও তাদের মিত্ররাষ্ট্র রোমানিয়া ও হাঙ্গেরিতেও শত শত টন বোমা আকাশপথে নিক্ষিপ্ত হয়, রোমানিয়ার তেলশিল্পকে ধ্বংস করতে "অপারেশন টাইডাল ওয়েইভ" নামক বিমান হামলা অভিযান চালানো হয়।

    এছাড়াও উত্তর সাগরের রসদবাহী নৌবহর দ্বারা ব্রিটিশ ও কমনওয়েল্‌থভুক্ত রাষ্ট্রসমূহ সোভিয়েতদের সহায়তা করে, এবং ব্রিটিশ "রাজকীয় বিমান বাহিনীর" (RAF) প্রশিক্ষকেরা সোভিয়েত "লাল বিমান বাহিনী"র পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাদেরকে রসদ ও গোয়েন্দা তথ্য প্রদান করেও সহায়তা করে থাকে।

    সোভিয়েত ইউনিয়নকে মিত্রবাহিনীর সরবরাহকৃত রসদের পরিমাণ[৫৩]
    সালপরিমাণ
    (টন)
    %
    ১৯৪১৩,৬০,৭৭৮২.১
    ১৯৪২২৪,৫৩,০৯৭১৪
    ১৯৪৩৪৪,৯৪,৫৪৫২৭.৪
    ১৯৪৪৬২,১৭,৬২২৩৫.৫
    ১৯৪৫৩৬,৭৩,৮১৯২১
    মোট১,৭৪,৯৯,৮৬১১০০

    সোভিয়েত ইউনিয়নসম্পাদনা

    অন্যান্য রসদ সরবরাহের পাশাপাশি "লেন্ড-লীজ" চুক্তি মোতাবেক যে সম্পদ ও রসদ সরবরাহ করা হয়: ("লেন্ড-লীজ" ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য মিত্ররাষ্ট্রকে প্রদত্ত রসদ, অস্ত্রশস্ত্র, জ্বালানী, যানবাহন ইত্যাদি সাহায্য, যার জন্য যুদ্ধ চলাকালীন কোন মূল্য নেয়া হয়নি।)[৫৪]:৮–৯

    • সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধবিমানের জন্যে উচ্চমাত্রায় অকটেনসম্পন্ন জ্বালানীর ৫৮%
    • তাদের মোটরযান সমূহের ৩৩%
    • সোভিয়েত ইউনিয়নে গোলাবারুদ, মাইন, বিস্ফোরক ইত্যাদির মোট জাতীয় উৎপাদনের ৫৩%
    • জঙ্গী বিমান ও বোমারু বিমানসমূহের ৩০%
    • রেলযোগাযোগ সরঞ্জাম (রেল ইঞ্জিন, মালগাড়ি, রেললাইন ইত্যাদি)-এর ৯৩%
    • ইস্পাতের পাত, তার, শীসা ও অ্যালুমিনিয়াম মজুদের ৫০-৮০%
    • গ্যারেজ সরঞ্জাম (নির্মাণ সামগ্রী এবং নকশা)-এর ৪৩%
    • ট্যাংক এবং গোলন্দাজ কামানবাহী যানসমূহের ১২%
    • টি.এন.টি.-এর ৫০% (১৯৪২-১৯৪৪) ও গোলাবারুদের ৩৩%[৫৫]
    • সকল বিস্ফোরক দ্রব্যের ১৬% (১৯৪১-১৯৪৫ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিজস্ব বিস্ফোরকের উৎপাদন ছিল ৫,০৫,০০০ টন এবং "লেন্ড-লীজ" আমদানী ছিল ১,০৫,০০০ টন)[৫৬]

    সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক প্রাপ্ত মোট বৈদেশিক সাহায্যের ২০% ছিল "লেন্ড-লীজ" থেকে প্রাপ্ত সামরিক সরঞ্জামাদি, যন্ত্রপাতি এবং সামরিক পণ্য।[৫৪]:১২২ বাকি ৮০% এর মধ্যে ছিল খাদ্যদ্রব্য, লোহা ব্যতীত অন্যান্য ধাতু (যেমন- তামা, ম্যাগনেসিয়াম, নিকেল, জিঙ্ক, সীসা, টিন, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি), রাসায়নিক দ্রব্যাদি, পেট্রোলিয়াম (উচ্চমাত্রায় অকটেনযুক্ত উড়োজাহাজের জ্বালানী) এবং কলকারখানার যন্ত্রপাতি। উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে।[৫৪]:১২২ এছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধকালীন উদ্ভাবনসমূহও প্রাপ্ত হয়, যার মধ্যে ছিল পেনিসিলিন, রাডার, রকেট, নিখুঁত লক্ষ্যসম্পন্ন বোমানিক্ষেপণ প্রযুক্তি, বহু দূরবর্তী রেডিও যোগাযোগ-ব্যবস্থা ("Long Range Navigation System" বা, "LORAN") ইত্যাদি বহু উদ্ভাবন।[৫৪]:১২৩

    সোভিয়েত ইউনিয়নকে ৮,০০,০০০ টন লোহা নয় এমন ধাতু চালান করা হয়,[৫৪]:১২৪ যার মধ্যে ৩,৫০,০০০ টন ছিল অ্যালুমিনিয়াম।[৫৪]:১৩৫ সরবরাহকৃত অ্যালুমিনিয়াম ছিল জার্মানির জাতীয় উৎপাদনের দ্বিগুণ, সোভিয়েত উড়োজাহাজসমূহ তৈরি করতে ব্যবহৃত অ্যালুমিনিয়ামের অধিকাংশ আসে এই চালান থেকে, এর আগে অ্যালুমিনিয়ামের অভাবে সোভিয়েতদের উড়োজাহাজ নির্মাণ ব্যপকভাবে কমে যায়।[৫৪]:১৩৫ সোভিয়েত পরিসংখ্যান মতে, অ্যালুমিনিয়ামের এই চালান না এলে, তাদের উৎপাদিত বিমানের সংখ্যা অর্ধেক হত। কোন চালান সহায়তা ছাড়া তারা নির্মাণ করতে পারত ৪৫,০০০ কিংবা তার থেকেও কম সংখ্যক বিমান, যেখানে তারা নির্মাণ করে ১,৩৭,০০০ বিমান।[৫৪]:১৩৫

    ১৯৪৪ সালে স্টালিন বলেন, সোভিয়েতদের ভারি শিল্পের দুই-তৃতীয়াংশ নির্মিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে, এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ নির্মিত হয় ব্রিটেন, কানাডা ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সহায়তায়।[৫৪]:১২৯ সোভিয়েত অধিকৃত অঞ্চলসমূহ থেকেও তারা প্রচুর পরিমাণে সরঞ্জাম ও দক্ষ লোকবল সংগ্রহ করে, যা তাদের অর্থনীতিকে আরো এগিয়ে নেয়।[৫৪]:১২৯ "লেন্ড-লীজ" সাহায্য ছাড়া জার্মান আক্রমণের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না, তাদেরকে শুধুমাত্র যন্ত্রপাতি, খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্যসমূহ উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ থাকতে হত।[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন].[৫৪]:১২৯

    যুদ্ধের শেষ বর্ষে এসে "লেন্ড-লীজ"-এর তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে ৫১ লক্ষ টন খাদ্যসামগ্রী যুক্তরাষ্ট্র থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে চালান করা হয়েছে।[৫৪]:১২৩ আনুমানিক হিসাব মতে, যে খাদ্যদ্রব্য রাশিয়াকে সরবরাহ করা হয়েছিল তা দিয়ে যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল জুড়ে ১,২০,০০,০০০ সৈন্যের প্রতিজনকে প্রতিদিন আধা পাউন্ড ঘনীভূত খাদ্য সরবরাহ করা যায়।[৫৪]:১২২–৩

    ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন সরবরাহকৃত মোট "লেন্ড-লীজ" সাহায্যের অর্থমূল্য হিসেব করলে দেখা যায় যে, ৪২-৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের সাহায্য প্রদান করা হয়েছিল।[৫৪]:১২৮ সোভিয়েত ইউনিয়ন যে যুদ্ধ সামগ্রী, সামরিক সাজ-সরঞ্জাম ও অন্যান্য দ্রব্য প্রাপ্ত হয়েছিল তার মূল্য ১২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা অন্যান্য মিত্রদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহকৃত সাহায্যের এক-চতুর্থাংশ।[৫৪]:১২৩ তবে, যুদ্ধ পরবর্তী সমঝোতা আলোচনায় এসকল ঋণের পরিমাণ নিয়ে বিতর্কের মীমাংসা হয়নি,[৫৪]:১৩৩ এমনকি বর্তমান সময়েও, ভবিষ্যৎ মার্কিন-রুশ সম্মেলন ও বৈঠকসমূহে এই ঋণের বিষয় আলোচনা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।[৫৪]:১৩৩–৪

    প্রফেসর ড. আলবার্ট এল. উইক্‌সের মতে: "২য় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব রণাঙ্গনে রাশিয়ার বিজয়ের পেছনে চার বছর-ব্যপী সরবরাহকৃত ঐসমস্ত চালান ও লেন্ড-লীজ সাহায্যের গুরুত্ব কতটুকু ছিল, যা নিয়ে বিচারকবৃন্দ এখনো ভাবছেন- তা হল, এই বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা যে যথার্থভাবে এর গুরুত্ব কতটা ছিল।"[৫৪]:১২৩

    নাৎসি জার্মানিসম্পাদনা

    ১৯৪২ সালে জার্মানির দখলদারিত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে ইউরোপ।

    অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, গবেষণামূলক ও শিল্প সংক্রান্ত প্রযুক্তিতে জার্মানি তখন বিশ্বের সবচাইতে উন্নত রাষ্ট্রসমূহের অন্যতম ছিল। তবে, তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের উৎসসমূহের যোগান ও তাদের নিয়ন্ত্রণ, কাঁচামাল ও উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদি সীমিত ছিল, কিন্তু এগুলো তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাসমূহ (ইউরোপ নিয়ন্ত্রণ, জার্মান অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তার, সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস ইত্যাদি) বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য ছিল। রাজনৈতিক চাহিদা থেকে জার্মানির প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, শিল্পসমূহের উৎপাদনক্ষমতা এবং চাষযোগ্য ভূমির জন্যে জার্মানিকে তার সীমান্ত বিস্তার করতে হত, তথা নতুন ভূখণ্ড দখল করতে হত। জার্মানির সামরিক উৎপাদন নির্ভর করত এর নিজস্ব ভূখণ্ডের বাইরে থেকে আগত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর, মিত্রবাহিনীর রাষ্ট্রসমূহকে এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি।

    যুদ্ধকালীন জার্মানি যেসমস্ত অঞ্চল অধিকার করেছিল (সরাসরি আক্রমণ ও দখলের মাধ্যমে অথবা পুতুল সরকার স্থাপনের মাধ্যমে), সেসমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের বাধ্য করা হয় জার্মান ক্রেতাদেরকে অতি স্বল্পমূল্যে কাঁচামাল ও কৃষিপণ্য বিক্রয় করতে। ১৯৪১ সালের ফ্রান্সের সকল রেলগাড়ির দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবহৃত হয় জার্মানিতে পণ্য বহন করে নিয়ে যেতে। নরওয়ে ১৯৪০ সালে তার মোট জাতীয় আয়ের ২০% হারায়, এবং ১৯৪৩ সালে এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০%-এ।[৫৭] অক্ষশক্তিতে অংশ নেয়া জার্মানির মিত্ররা, যেমন, রোমানিয়া, ইতালি, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া ও বুলগেরিয়া জার্মানদের মোট আমদানী থেকে লাভবান হত। ভিচি ফ্রান্স থেকে প্রাপ্ত সম্পদ জার্মানির যুদ্ধ প্রস্তুতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। ১৯৪৩-৪৪ সালে, ফ্রান্সের মোট জাতীয় আয়ের (জি.ডি.পি.) প্রায় ৫৫ শতাংশ জার্মানির হস্তগত করতে হয়।[৫৮] সবমিলে জার্মানি মোট খাদ্যদ্রব্যের ২০% এবং মোট কাঁচামালের ৩৩% আসত এর দখলকৃত অঞ্চলসমূহ থেকে ও অক্ষশক্তির অন্তর্গত জার্মানির মিত্র রাষ্ট্রসমূহ থেকে।[৫৯]

    ১৯৪০ সালের ২৭ মে তারিখে জার্মানি রোমানিয়ার সাথে "তেল চুক্তি"তে সাক্ষর করে, যে চুক্তি মোতাবেক জার্মানি তেলের বিনিময়ে অস্ত্র সরবারাহ করে। রোমানিয়ার বার্ষিক তেল উৎপাদন ছিল প্রায় ৬০,০০,০০০ টন। এই উৎপাদন অক্ষশক্তির মোট উৎপাদনের শতকরা ৩৫ ভাগ ছিল, যার মধ্যে কৃত্রিম ও বিকল্প পণ্যসমূহও অন্তর্ভুক্ত, এবং খনিজ তেলের ৭০% ছিল রোমানিয়া থেকে প্রাপ্ত।[৬০] ১৯৪১ সালে জার্মানির শান্তিকালীন তেল মজুদের মাত্র ১৮% অবশিষ্ট থাকে। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সালের মধ্যে জার্মানি ও অক্ষশক্তির অন্য মিত্রদেরকে রোমানিয়া প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ ব্যারেল তেল সরবরাহ করে থাকে (বার্ষিক প্রায় ৪০ লক্ষ ব্যারেল)। ১৯৪৪ সালে জার্মানির তেল উৎপাদন শীর্ষে পৌঁছায়, তখন তাদের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল বার্ষিক ১ কোটি ২০ লক্ষ ব্যারেল।[৬১]

    রল্‌ফ কার্লবম আনুমানিক হিসেব করেন যে, ১৯৩৩-৪৩ সালে জার্মানির মোট ব্যবহৃত লোহার শতকরা ৪৩ ভাগ আসত সুইডেন থেকে। একথাও সত্য হতে পারে যে, 'হিটলারের শাসনামলে জার্মানির প্রতি দশটি বন্দুকের চারটি তৈরি হত সুইডেন থেকে আগত কাঁচামাল দিয়ে।'[৬২]

    জোরপূর্বক শ্রমসম্পাদনা

    ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নাৎসি জার্মানিতে ও জার্মান অধিকৃত ইউরোপে নজিরবিহীন ভাবে বিদেশী জনগণকে জোরপূর্বক শ্রমে খাটানো কিংবা দাসবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়।[৬৩] জার্মানদের দখলকৃত অঞ্চলসমূহের অর্থনৈতিক অপব্যবহারের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জার্মান অধিকৃত ইউরোপের জনসংখ্যার গণহারে বিলুপ্তিতে এটি ভূমিকা রাখে। জার্মানরা প্রায় ২০টি ইউরোপীয় রাষ্ট্রের প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষকে অপহরণ কিংবা জোরপূর্বক আটক করে; এর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ছিল মধ্য ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপের অধিবাসী।[৬৪] মৃত ও ছাঁটাইকৃত ব্যক্তিদের গণ্য করে, যুদ্ধের যেকোনো পর্যায়ে প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ নারী-পুরুষকে জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা হয়।[৬৫] উদাহরণস্বরূপ, ১৫ লক্ষ ফরাসি নাগরিককে জার্মানির যুদ্ধবন্দী শিবিরসমূহে জিম্মি হিসেবে আটকে রাখা হয় ও জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা হয়। ১৯৪৩ সালে ৬,০০,০০০ ফরাসি বেসামরিক নাগরিকগণকে জোর করে জার্মানিতে বদলি হয়ে যুদ্ধ-কারখানাসমূহে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।[৬৬]

    ১৯৪৫ সালে জার্মানির পরাজয়ের পর প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ বিদেশী নাগরিক মুক্তি লাভ করে (যাদেরকে "বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিবর্গ" হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়), যাদের অধিকাংশই ছিল জোরপূর্বক নিযুক্ত শ্রমিক ও যুদ্ধবন্দী। যুদ্ধ চলাকালে জার্মান বাহিনী সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীদের পাশাপাশি প্রায় ৬৫ লক্ষ বেসামরিক নাগরিকগণকে রাইখে নিয়ে আসে এবং তাদের কলকারখানাসমূহে কাজ করতে বাধ্য করে।[৬৪] যুদ্ধ শেষে প্রায় ৫২ লক্ষ বিদেশী শ্রমিককে সোভিয়েত ইউনিয়নে পুনর্বাসন করা হয়, এছাড়াও ১৬ লক্ষ শ্রমিক পোল্যান্ডে, ১৫ লক্ষ ফ্রান্সে, ৯ লক্ষ ইতালিতে, এবং যুগোস্লাভিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, নেদারল্যান্ডস, হাঙ্গেরি ও বেলজিয়ামের প্রতটি রাষ্ট্রে ৩ থেকে ৪ লক্ষ শ্রমিক পুনর্বাসিত হয়।[৬৭]

    যুদ্ধ পরিচালনার পর্যায়সমূহসম্পাদনা

    মানচিত্র: ১৯৪১ সালের ২২শে জুন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন (ইউক্রেনীয়)

    পূর্ব রনাঙ্গনের যুদ্ধকে জার্মান ইতিহানবিদগণ কোন পর্যায়ভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ না করলেও, সোভিয়েত ও রুশ ইতিহাসবিদগণ সকলেই জার্মানি ও এর মিত্রদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করেন। যা আবার রণাঙ্গনের ৮টি মূল অভিযানে উপবিভক্ত হয়:[৬৮]

    • প্রথম পর্যায় (রুশ: Первый период Великой Отечественной войны) (২২ জুন, ১৯৪১ - ১৮ নভেম্বর, ১৯৪২)
    1. ১৯৪১ সালের গ্রীষ্ম-শরৎকালীন অভিযান (রুশ: Летне-осенняя кампания 1941 г.) (২২ জুন - ৪ ডিসেম্বর, ১৯৪১)
    2. ১৯৪১-৪২ সালের শীতকালীন অভিযান (রুশ: Зимняя кампания 1941/42 г.) (৫ ডিসেম্বর, ১৯৪১ - ৩০ এপ্রিল, ১৯৪২)
    3. ১৯৪২ সালের গ্রীষ্ম-শরৎকালীন অভিযান (রুশ: Летне-осенняя кампания 1942 г.) (১মে - ১৮ নভেম্বর, ১৯৪২)
    • দ্বিতীয় পর্যায় (রুশ: Второй период Великой Отечественной войны) (১৯ নভেম্বর, ১৯৪২ - ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৩)
    1. ১৯৪২-৪৩ সালের শীতকালীন অভিযান (রুশ: Зимняя кампания 1942–1943 гг.) (১৯ নভেম্বর, ১৯৪২ - ৩ মার্চ, ১৯৪৩)
    2. ১৯৪৩ সালের গ্রীষ্ম-শরত্কালের অভিযান (রুশ: Летне-осенняя кампания 1943 г.) (১ জুলাই - ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৩)
    • তৃতীয় পর্যায় (রুশ: Третий период Великой Отечественной войны) (১ জানুয়ারি, ১৯৪৪ - ৯ মে, ১৯৪৫)
    1. শীত-বসন্তকালীন অভিযান (রুশ: Зимне-весенняя кампания 1944 г.) (১ জানুয়ারি - ৩১ মে, ১৯৪৪)
    2. গ্রীষ্ম-শরত্কালীন অভিযান (রুশ: Летне-осенняя кампания 1944 г.) (১ জুন - ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৪)
    3. ১৯৪৫ সালের ইউরোপ অভিযান (রুশ: Кампания в Европе 1945 г.) (১ জানুয়ারি - ৯ মে, ১৯৪৫)

    "অপারেশন বারবারোসা": গ্রীষ্ম, ১৯৪১সম্পাদনা

    "অপারেশন বারবারোসা": জার্মানি কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ, ২১ জুন, ১৯৪১ থেকে ৫ ডিসেম্বর, ১৯৪১:
      ৯ জুলাই, ১৯৪১ পর্যন্ত
      ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ পর্যন্ত
      ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১ পর্যন্ত
      ৫ ডিসেম্বর, ১৯৪১ পর্যন্ত

    ১৯৪১ সালের ২২শে জুন ভোর হবার ঠিক পূর্বে আরম্ভ হয় "অপারেশন বারবারোসা"। লাল ফৌজের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে জার্মানরা সোভিয়েতদের পশ্চিম প্রান্তের সামরিক অঞ্চলসমূহের সমস্ত টেলিফোন-টেলিগ্রাফ তার কেটে দেয়।[৬৯] সোভিয়েত সম্মুখ সারির হতভম্ব সেনাসদস্যরা তড়িঘড়ি করে তাদের সদর দপ্তরে যে বার্তা পাঠায় তা হল: "আমাদের ওপর গুলিবর্ষণ হচ্ছে। আমরা কি করব?" এর যে জবাব পাঠানো হয় তা অনুরূপ বিভ্রান্তিকর: "তোমরা উন্মাদ হয়ে গেছ। আর তোমাদের বার্তা গুপ্ত সংকেতে পাঠাওনি কেন?"[৭০]

    ১৯৪১ সালের ২২শে জুন, ভোর ৩টা ১৫ মিনিটে, মোট ১৯০টির মধ্যে ৯৯টি জার্মান ডিভিশন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাল্টিক সাগরকৃষ্ণ সাগর অঞ্চলে আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে ১৫টি প্যানজার (ট্যাংক) ডিভিশন, ১০টি যুদ্ধযান ডিভিশন ছিল। তাদের সহযোগিতায় ছিল ১০টি রোমানীয় ডিভিশন, ৯টি রোমানীয় ব্রিগেড ও ৪টি হাঙ্গেরীয় ব্রিগেড।[৭১] একই দিনে, বাল্টিক, পশ্চিম ও কিয়েভ বিশেষ সামরিক জেলার নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয় যথাক্রমে, উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গন, পশ্চিম রণাঙ্গন ও দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন।[৬৯]

    আকাশপথে কর্তৃত্ব স্থাপন করতে জার্মান বিমানবাহিনী "লুফ্‌টওয়াফ" সোভিয়েত বিমান ঘাঁটিসমূহে হামলা চালায়, যাতে সীমান্তবর্তী এলাকায় নির্মিত সোভিয়েত বিমানবাহিনীর বিমানঘাঁটিগুলোর অধিকাংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এসব বিমানঘাঁটিতে যেসকল পুরাতন অপ্রচলিত যুদ্ধ-বিমান ছিল, তাদের পাইলটেরা উড্ডয়নের সুযোগই পায়নি।[৭২] পরবর্তী এক মাস তিনটি অক্ষে পরিচালিত আক্রমণ একেবারেই অনির্বার গতিতে এগিয়ে চলে, দ্রুতগতির প্যানজার ট্যাংক বাহিনীসমূহ শত হাজার সোভিয়েত সেনাদের এক একটি দলকে ঘেরাও করে ফেলে অতঃপর ধীরগতির পদাতিক বাহিনী তাদেরকে আক্রমণ করে পরাস্ত করে দেয়। একই সময়ে প্যানজারসমূহ আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে, এসময় জার্মানদের দুর্বার "ব্লিট্‌জক্রীগ" (ঝটিকা আক্রমণ) পদ্ধতিতে তারা যুদ্ধ পরিচালনা করে থাকে।

    "উত্তর যুগ্ম সৈন্যদল" (Army Group North)-এর দায়িত্ব ছিল বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ (লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া) হয়ে লেনিনগ্রাড (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) আক্রমণ করা। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৬শ এবং ১৮শ ওয়েরমাক্‌ট সেনাবাহিনী এবং ৪র্থ প্যানজার ট্যাংক বাহিনী। এই যুগ্ম সৈন্যদলটি বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ হয়ে রাশিয়ার স্কভ ও নোভগরড প্রদেশে প্রবেশ করে। স্থানীয় বিদ্রোহীরা ("ফরেস্ট ব্রাদার্স") এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, জার্মানদের আক্রমণের ঠিক পূর্বে লিথুয়ানিয়ার অধিকাংশ, উত্তর লাটভিয়া এবং দক্ষিণ এস্তোনিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়।[৭৩][৭৪]


    "মধ্য যুগ্ম সৈন্যদল" (Army Group Centre)-এর অধীন দু'টি প্যানজার বহর (২য় এবং ৩য় প্যানজার বহর), বেলারুশের ব্রেস্ট-লিটভ্‌স্ক নগরীর উত্তর ও দক্ষিণ হয়ে মিন্‌স্ক নগরীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের অনুসরণ করে ২য়, ৪র্থ এবং ৯ম ওয়েরমাক্‌ট সেনাবাহিনী। যাত্রা শুরুর মাত্র ৬ দিনের মধ্যে সম্মিলিত প্যানজার বহরটি বেরেসিনা নদীর তীরে পৌঁছে যায়, ৬৫০ কি.মি. পথ অতিক্রম করে। তাদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল নীপার নদী অতিক্রম করা, যা তারা ১১ জুলাইয়ের মধ্যে সফলভাবে পার করে। পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু ছিল রাশিয়ার স্মোলেন্‌স্ক প্রদেশ, যার পতন হয় ১৬ জুলাই, কিন্তু স্মোলেন্‌স্ক অঞ্চলে জার্মানরা সোভিয়েতদের তুমুল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় (স্মোলেন্‌স্কের যুদ্ধ, ১৯৪১), এতে উত্তর ও দক্ষিণ জার্মান বাহিনীর অগ্রসর হবার গতি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে, ফলে হিটলার বাধ্য হন তার কেন্দ্রীয় মস্কো আক্রমণ পরিকল্পনাকে স্থগিত করতে এবং এর পরিবর্তে ৩য় প্যানজার বহরকে উত্তরে আক্রমণের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। এবং জেনারেল হাইঞ্জ গুডেনবার্গের নেতৃত্বে ২য় প্যানজার বহরকে দক্ষিণে পাঠানো হয় যাতে তারা উত্তরের প্যানজার বহরের সাথে সম্মিলিতভাবে ইউক্রেন অঞ্চলে এক বিশাল সাঁড়াশি আক্রমণ চালাতে পারে। এর ফলে "কেন্দ্রীয় যুগ্ম সৈন্যদলের" পদাতিক ডিভিশনসমূহ তাদের ট্যাংক বাহিনীর প্রতিরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, এতে তাদের মস্কো অভিমুখে অগ্রযাত্রার গতি মন্থর হয়ে পড়ে।[৭৫]

    এই সিদ্ধান্তটি জার্মানদের মধ্য ব্যপক নেতৃত্ব বিপর্যয় সৃষ্টি করে। জার্মান যুদ্ধক্ষেত্রের কমান্ডারগণ মস্কো অভিমুখে অনতিবিলম্বে আক্রমণ পরিচালনা করার পক্ষে জোরালোভাবে মত দিলেও হিটলার তাদের মতামতনাকচ করে দেন, তিনি ইউক্রেনের কৃষিভূমি, খনিজ সম্পদ ও শিল্পসমূহের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়া তিনি কেন্দ্রীয় যুগ্ম সৈন্যদলের দক্ষিণ ভাগ ও স্থবির হয়ে পড়া দক্ষিণ যুগ্ম সৈন্যদলের উত্তর ভাগের মধ্যবর্তী গমেল প্রদেশে সোভিয়েতদের বিশালাকার সৈন্য সমাবেশের ওপর মনোনিবেশ করেন। ধারণা করা হয়, "হিটলারের গ্রীষ্ম বিরতি"[৭৫] নামে পরিচিত এই সিদ্ধান্তটি পরবর্তী মস্কোর যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে বিস্তর প্রভাব ফেলেছিল। এই সিদ্ধান্তের ফলে, কিয়েভে সোভিয়েতদের বিশাল সৈন্য সমাবেশকে ঘেরাও করার জন্যে মস্কো অভিমুখে যাত্রার গতিকে ব্যপকভাবে মন্থর করে দেয়া হয়।[৭৬]

    "দক্ষিণ যুগ্ম সৈন্যদল" (Army Group South)-এর অন্তর্ভুক্ত "১ম প্যানজার বহর", ৬ষ্ঠ, ১১শ এবং ১৭শ ওয়েরমাক্‌ট বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয় গ্লাসিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হবার। তবে তাদের যাত্রার গতি ছিল অনেকটা মন্থর এবং "ব্রডির যুদ্ধে" (১৯৪১) সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ট্যাংক সংঘর্ষে তারা ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জুলাইয়ের শুরুতে ৩য় ও ৪র্থ রোমানীয় সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্র ১১শ জার্মান সেনাবাহিনী ইউক্রেনের বেসারাবিয়া অঞ্চলের মধ্য দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে ওডেসা নগরীতে পৌঁছে। এদিকে ১ম প্যানজার বাহিনী কিয়েভ থেকে সরে এসে নীপার নদীর বাঁকে অবস্থান নেয় (পশ্চিম নিপ্রোপেট্রোভ্‌স্ক প্রদেশে)। এই প্যানজার বহর দক্ষিণ যুগ্ম সৈন্যদলের অংশবিশেষের সাথে মিলিত হয়, এই সম্মিলিত বাহিনী রাশিয়ার উমান শহরে হামলা চালায় এবং উমানের যুদ্ধে সোভিয়েতদের বিশাল সৈন্যসমাবেশকে ঘেরাও করে ফেলে এবং ১,০০,০০০ সোভিয়েত সৈন্যকে যুদ্ধবন্দী করে। দক্ষিণ যুগ্ম সৈন্যদলের অন্তর্ভুক্ত ট্যাংক ডিভিশনসমূহ মধ্য সেপ্টেম্বরে জেনারেল গুডেরিয়ানের ২য় প্যানজার বহরের সাথে লোখভিৎসিয়া নগরীর কাছে মিলিত হয়, তারা কিয়েভের পূর্বে অবস্থিত বিশাল লাল ফৌজ সৈন্যবাহিনীকে তাদের অপরাপর বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।[৭৫] ১৯৪১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কিয়েভের যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে ৪,০০,০০০ সোভিয়েত সেনা যুদ্ধবন্দী হয়ে পড়ে।[৭৫]

    ১৯৪১ সালের জুন মাসে, যুদ্ধের প্রথম দিনগুলোতে জার্মান বিমান হামলার সময় সোভিয়েত শিশুরা, রুশ সংবাদ মাধ্যমের (RIA Novosti) আর্কাইভ থেকে।

    সোভিয়েত লাল ফৌজ নীপার ও দ্‌ভিনা নদীদ্বয়ের অপর পাড়ে পিছিয়ে গেলে, সোভিয়েত কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ স্তাভ্‌কা পশ্চিম অঞ্চলের সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ যতটা সম্ভব অন্যত্র অপসারণের প্রচেষ্টা চালায়। যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখ সারির নিকটবর্তী সমস্ত কলকারখানার যন্ত্রাংশসমূহ সরিয়ে নেয়া হয় এবং মালবাহী রেলগাড়িতে করে দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে স্থানান্তর করা হয়, মূলতঃ ইউরাল পর্বত, ককেশাস, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব সাইবেরিয়ার দুর্গম অঞ্চলে এসব শিল্প-কারখানা পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করা হয়। বেসামরিক নাগরিকদের অধিকাংশকেই পেছনে ফেলে আসা হয়, শুধুমাত্র কলকারখানা শ্রমিকদেরকে তাদের যন্ত্রপাতি সমেত রেলগাড়িতে পরিবহন করা হয়, অন্যান্যদেরকে শত্রুদের করুণার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়।

    স্টালিন লাল ফৌজকে নির্দেশ দেন "পোড়ামাটির নীতি" পালন করতে, যাতে তাদের পিছু ধাওয়া করে আসা পূর্বগামী জার্মানরা সকল রসদ সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়। এই আদেশ পালনের জন্যে সোভিয়েত বাহিনী কতিপয় "বিধ্বংসী" ব্যাটালিয়ন গঠন করে, তারা সন্দেহভাজন যেকোন ব্যক্তিকে হত্যা করে। এই বিধ্বংসী ব্যাটালিয়নসমূহ গ্রাম, বিদ্যালয় এবং সকল সরকারি দালানকোঠা পুড়িয়ে দেয়।[৭৭] এই নীতি অনুসরণ করে সোভিয়েত এন.কে.ভি.ডি. বাহিনী হাজার হাজার সোভিয়েত-বিরোধী বন্দীদের ওপর গণহত্যা চালায়।[৭৮]

    লেনিনগ্রাড, মস্কো ও রুস্তভের যুদ্ধ: শরৎ, ১৯৪১সম্পাদনা

    ওয়েরমাক্‌ট সৈন্যরা কাদা থেকে একটি গাড়িকে টেনে তুলছে, ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাসে "রাসপুতিস্তা" ঋতুতে (রাশিয়ার বরফে ঢাকা শীতকাল)।

    অতঃপর হিটলার মস্কো অভিমুখে যাত্রা পুনরায় আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত নেন, প্যানজার দলগুলোকে পুনরায় প্যানজার বাহিনী আকারে সজ্জিত করা হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া "অপারেশন টাইফুন" চলাকালে, ২য় প্যানজার বাহিনী ওরিয়োল নগরী (৫ নভেম্বর দখলকৃত) থেকে ওকা নদী অভিমুখে বাঁধানো রাস্তা দিয়ে যাত্রা করতে থাকে, এবং একই সাথে ৪র্থ প্যানজার বাহিনী (উত্তর যুগ্ম সৈন্যদল থেকে কেন্দ্র স্থানান্তরিত) এবং ৩য় প্যানজার বাহিনী ভিয়াজ্‌মা ও ব্রিয়ান্‌স্ক নগরীদ্বয়ে সোভিয়েত বাহিনীর দুটি বিশালাকার দলকে ঘেরাও করে ফেলে।[৭৯] উত্তর যুগ্ম সৈন্যদলটি লেনিনগ্রাডের সামনে অবস্থান নেয় এবং এ নগরীর সাথে পূর্বের ম্‌গা নগরীর রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।[৮০] এর সাথে সূচনা হয় ৯০০ দিন-ব্যপী অব্যাহত লেনিনগ্রাড অবরোধ। উত্তর মেরুতে একটি জার্মান-ফিনীয় বাহিনী মুর্মান্‌স্ক নগরী দখল করতে অগ্রসর হয়, তবে তারা জাপাদ্‌নায়া লিট্‌সা নদী পার হতে ব্যর্থ হয়, ফলে সেখানেই তারা ঘাঁটি গেড়ে বসে।[৮১]

    দক্ষিণ যুগ্ম সৈন্যদল নীপার নদী থেকে খার্কভ, কুর্স্ক এবং স্টালিনো নগরীর মধ্য দিয়ে আজভ্‌ সাগরের উপকূল পর্যন্ত আক্রমণ চালিয়ে অগ্রসর হয়। জার্মান ও রোমানীয় সম্মিলিত বাহিনী ক্রিমিয়াতে অনুপ্রবেশ করে এবং শরতের পূর্বেই সমগ্র উপদ্বীপ দখল করে নেয় (সেভাস্টপুল নগরী বাদে, যা ১৯৪২ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যায়)। ২১ নভেম্বর ওয়েরমাক্‌ট বাহিনী রুস্তভ্ নগরী দখল করে নেয়, (রুস্তভের যুদ্ধ, ১৯৪১), যা ককেশাস অঞ্চলে প্রবেশের দ্বারপ্রান্ত স্বরূপ। তবে এ আক্রমণে জার্মান সারিটি অতিরিক্ত সম্প্রসারিত ও বিস্তৃত হয়ে পড়ে, এর সুযোগে সোভিয়েতরা ১ম প্যানজার বাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ চালালে তারা রুস্তভ্‌ নগরী ছেড়ে মিনাস নদীর অপর পাড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়; এ আক্রমণে জার্মানদের পিছু হটা ছিল যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়।[৮২][৮৩]

    ওডেসা নগরীতে দুজন রোমানীয় সৈন্য কর্তৃক জাতীয় পতাকা উত্তোলন, ১৯৪১

    ১৫ নভেম্বর শীতকালীন তুষারপাতের শুরুতে জার্মানরা আরেকটি আক্রমণ পরিচালনা করে, যখন ওয়েরমাক্‌ট মস্কো নগরী ঘেরাও করার প্রচেষ্টা চালায়। ২৭ নভেম্বর ৪র্থ প্যানজার বাহিনী মস্কো নগরীর কেন্দ্রে ক্রেমলিন চত্বর পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যা ছিল মস্কোর ট্রাম লাইনের শেষ বিরতি, "খিমকি"। তবে একই সময়ে, ২য় প্যানজার বাহিনী টূলা নগরী দখল করতে ব্যর্থ হয়, যা ছিল মস্কোর যাত্রার পথে শেষ সোভিয়েত নগরী। ওর্শা নগরীতে অনুষ্ঠিত জার্মান সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের ("OKH") বৈঠকে অংশ নেন সেনাপ্রধান জেনারেল ফ্রান্‌জ হ্যালডার এবং তিনটি যুগ্ম সেনাবাহিনী (Army Group)-এর প্রধানগণ, তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে মস্কো অভিমুখে অগ্রসর হওয়াই উত্তম, কেননা বসে বসে অপেক্ষা করলে শত্রুপক্ষকে শক্তি সংগ্রহের সুযোগ দেয়া হবে, এর চাইতে বরং যুদ্ধক্ষেত্রে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখাই উত্তম।[৮৪]

    তবে, ৬ ডিসেম্বর প্রমাণিত হয় যে, মস্কো দখল করে নেয়ার মত শক্তি "ওয়েরমাক্‌ট"-এর ছিল না, এবং তাদের আক্রমণ স্থগিত করে দেয়া হয়। সোভিয়েত মার্শাল শাপোশনিকভ্ তাই পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ করেন, তিনি তার নব নিযুক্ত সেনাবিভাগসমূহকে কাজে লাগান,[৮৫] এবং তাদের সাথে সু-প্রশিক্ষিত দূরবর্তী প্রাচ্যের সৈন্য ডিভিশনসমূহকেও নিযুক্ত করা হয়, পূর্বদিকে জাপান নিরপেক্ষ থাকবে এই তথ্য পেয়ে প্রাচ্যের সেনাদেরকে পূর্ব থেকে বদলি করে নিয়ে আসা হয়েছিল।[৮৬]

    সোভিয়েত পাল্টা আক্রমণ: ১৯৪১ সালের শীতকালসম্পাদনা

    সোভিয়েত বাহিনীর শীতকালীন পাল্টা-আক্রমণ, ৫ ডিসেম্বর, ১৯৪১ থেকে ৭ মে, ১৯৪২:
      সোভিয়েত অধিকৃত অঞ্চল
      জার্মান অধিকৃত অঞ্চল

    মস্কোর যুদ্ধে সোভিয়েতদের পাল্টা আক্রমণে নগরীটি জার্মানদের প্রত্যক্ষ আক্রমণ থেকে প্রাথমিকভাবে সুরক্ষিত হয়। জেনারেল জুকভের মতে, "কেন্দ্রীয় কৌশলগত নির্দেশনায় ডিসেম্বরের পাল্টা আক্রমণের সাফল্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। জার্মান কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনী পাল্টা আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটা শুরু করে।" ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে স্টালিনের লক্ষ্য ছিল, "জার্মানদের শ্বাস নেয়ার সুযোগ না দেয়া, তাদের বিরতিহীনভাবে পশ্চিম দিকে তাড়া করে নিতে থাকা, বসন্তের আগেই যাতে তারা তাদের সংরক্ষিত সকল রসদ শেষ করে ফেলে..."[৮৭]

    সোভিয়েত উত্তর-পশ্চিম সৈন্যবিভাগ, কালিনিন বিভাগ ও সোভিয়েত পশ্চিম বিভাগ সম্মিলিতভাবে একটি সুবিশাল সাঁড়াশি আক্রমণ চালানোর, যা জার্মানদের মূলে আঘাত হানবে। জেনারেল জুকভের মতে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, "রেজেভ, ভিয়াজ্‌মা এবং স্মোলেন্‌স্ক অঞ্চলে একের পর এক শত্রুবাহিনীসমূহকে ঘেরাও করা এবং নির্মূল করা। লেনিনগ্রাড সৈন্যবিভাগ, ভলকভ বিভাগ এবং উত্তর-পশ্চিম বিভাগের ডান প্রান্তের সৈন্যদের দায়িত্ব ছিল জার্মান উত্তর যুগ্ম বাহিনীকে ধ্বংস করা। এবং ককেশীয় সৈন্যবিভাগ ও কৃষ্ণ সাগর রণতরী বহরের দায়িত্ব ছিল ক্রিমিয়া পুনর্দখল করা।[৮৭]:৫৩

    সোভিয়েত ২০ তম সেনাবাহিনী, যা ছিল ১ম ঝটিকাবাহিনীর অংশবিশেষ, ২২ তম ট্যাংক ব্রিগেড এবং ৫টি স্কি ব্যাটালিয়ন সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালায় ১৯৪২ সালের ১০ জানুয়ারি। ১৭ জানুয়ারির মধ্যে সোভিয়েতরা লোটোশিনো এবং শাখোভ্‌স্কায়া নগরী দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ২০ জানুয়ারির মধ্যে ৫ম ও ৩৩ তম সেনাবাহিনী রুজা, ডরোখোভো, মোজাইস্ক এবং ভেরেয়া নগরী দখল করে নেয়, একই সময়ে ৪৩ তম এবং ৪৯ তম সেনাবাহিনী ডোমানোভো নগরীতে পৌঁছে।[৮৭]:৫৮–৫৯

    ওয়েরমাক্‌ট পিছু হটে আসে, রেজেভ নগরীতে তারা একটি বহির্মুখ ঘাঁটির দখল ধরে রাখে। সোভিয়েত ২০১ উড্ডীয়মান ব্রিগেড এবং ২৫০ তম উড্ডীয়মান রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য প্যারাসুটে করে এই স্থানে অবতরণ করে এবং "পেছনের সাথে শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে" সচেষ্ট হয়। লেফটেনেন্ট জেনারেল মিখাইল গ্রিগরিভিচ য়েফ্রেমভের নেতৃত্বে ৩৩ তম সেনাবাহিনী এবং জেনারেল বেলবের নেতৃত্বে ১ম আরোহী সেনাবিভাগ এবং সোভিয়েত রাজনৈতিক কর্মীরা ভিয়াজ্‌মা নগরী দখল করতে সচেষ্ট হয়। জানুয়ারির শেষভাগে তাদের সাথে যোগ দেয় ৮ম উড্ডীয়মান ব্রিগেডের প্যারাসুট-বাহিত সেনারা। তবে ফেব্রুয়ারির প্রথমভাগে জার্মানরা এই বাহিনীকে জার্মানদের পেছনে অবস্থিত অপরাপর সোভিয়েত বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়। বাহিনীটিকে এপ্রিল পর্যন্ত আকাশপথে রসদ সরবরাহ করা হয়, অতঃপর তাদের নির্দেশ দেয়া হয় সোভিয়েত প্রধান বাহিনীর সাথে মিলিত হবার। যদিও কেবল বেলভের নেতৃত্বাধীন আরোহী সেনারাই বেঁচে ফিরতে পারে, কিন্তু য়েফ্রেমভের অধীন সেনারা আসন্ন পরজয় সামনে রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।[৮৭]:৫৯–৬২

    ১৯৪২ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় উচ্চ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় পুনরায় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করার যাতে তারা "দখলকৃত ভূখণ্ড পুনঃসংগঠিত করতে পারে"। জেনারেল জুকভ বলেন, "শীতকালীন আক্রমণের সময়, সোভিয়েত পশ্চিম সেনাবিভাগ ৭০ থেকে ১০০ কিলোমিটার অগ্রসর হতে সক্ষম হয়, যা (সোভিয়েত ইউনিয়নের) পশ্চিম অঞ্চলসমূহে সামগ্রিক কর্মসূচি ও রণকৌশলগত অবস্থানকে কিছুটা উন্নত করতে সক্ষম হয়।"[৮৭]:৬৪

    উত্তরে লাল ফৌজ ডেমিয়ান্‌স্ক নগরীতে একটি জার্মান সৈন্যসমাবেশকে ঘেরাও করে ফেলে, যারা চার মাস পর্যন্ত আকাশ পথে রসদ সরবরাহের দ্বারা টিকে থাকে এবং খোল্‌ম, ভেলিজ ও ভেলিকি লুকি শহরের সম্মুখে অবস্থান গ্রহণ করে।

    আরো উত্তরে, সোভিয়েত ২য় ঝটিকাবাহিনীকে ভোলকভ নদীতে প্রয়োগ করা হয়। প্রাথমিকভাবে তারা কিছুদূর অগ্রসর হতে সক্ষম হয়; তবে এই আক্রমণকে পরে স্থগিত করা হয়, এবং জুন মাসে জার্মানদের পাল্টা আক্রমণে এই বাহিনী বিচ্ছিন্ন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সোভিয়েত কমান্ডার লেফটেনেন্ট জেনারেল আন্দ্রেই ভ্লাসোভ বিশ্বাসঘাতকতা করে জার্মানির পক্ষাবলম্বন করেন এবং তার নেতৃত্বে গঠিত হয় রুশ স্বাধীনতা বাহিনী (Russian Liberation Army, ROA)।

    দক্ষিণে লাল ফৌজ ইজিয়াম নগরীর নিকটে দোনেত্‌স নদীতে আক্রমণ চালায় এবং ১০০ কিলোমিটার অঞ্চলে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল জার্মান দক্ষিণ যুগ্ম বাহিনীকে আজভ্ সাগর পেছনে রেখে আটকে ফেলা, কিন্তু শীত কেটে আসলে জার্মানরা পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং "খার্কভের ২য় যুদ্ধে" অধিক সম্প্রসারিত সোভিয়েত বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়।

    ডন, ভলগা এবং ককেশাস: ১৯৪২ সালের গ্রীষ্মসম্পাদনা

    "অপারেশন ব্লু":৭মে, ১৯৪২ থেকে ১৮ নভেম্বর, ১৯৪২ পর্যন্ত জার্মান বাহিনীর অগ্রগতি:
      ৭ জুলাই, ১৯৪২ পর্যন্ত
      ২২ জুলাই, ১৯৪২ পর্যন্ত
      ১ আগস্ট, ১৯৪২ পর্যন্ত
      ১৮ নভেম্বর, ১৯৪২ পর্যন্ত

    যদিও জার্মানদের পরিকল্পনা ছিল পুনরায় মস্কো আক্রমণ করার, তবুও ১৯৪২ সালের ২৮শে জুন এই আক্রমণ ভিন্ন দিকে পরিচালিত হয়। দক্ষিণ যুগ্ম বাহিনী এই আক্রমণ পরিচালনা করে, ভোরোনেজের যুদ্ধের (১৯৪২) মাধ্যমে তারা যাত্রা শুরু করে এবং ডন নদী বরাবর দক্ষিণ-পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকে। পরিকল্পনা ছিল প্রথমে ডন ও ভলগা নদী সুরক্ষিত করা অতঃপর ককেশাস অঞ্চলের খনিজ তেলক্ষেত্রসমূহ অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করা, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি এবং হিটলারের অহমিকা রক্ষার্থে তিনি উভয় অভিযানই একত্রে আরম্ভ করে দেন। ২৪ জুলাই ১ম প্যানজার বাহিনীর সহায়তায় রুস্তভ নগরী জার্মানরা পুনর্দখল করে নেয়, এরপর এই বাহিনী দক্ষিণে মাইকপ অভিমুখে যাত্রা করে। এ অভিযানের অংশ হিসেবে "অপারেশন শামিল" পরিচালিত হয়, যাতে একদল জার্মান কমান্ডো (ব্র্যান্ডেনবার্গার কমান্ডো) সৈন্য সোভিয়েত এন.কে.ভি.ডি. বাহিনীর সজ্জাগ্রহণ করে মাইকপ শহরে প্রবেশ করে এর প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ভন্ডুল করে দেয়, ফলে ১ম প্যানজার বাহিনী সহজেই এই তেল-ক্ষেত্রভিত্তিক শহরটি অধিকার করে।

    একই সময়ে, জার্মান ৬ষ্ঠ সেনাবাহিনী স্টালিনগ্রাড অভিমুখে যাত্রা করে, যাত্রার একটি বড় সময় ধরে তারা ৪র্থ প্যানজার বাহিনীর প্রতিরক্ষা ছাড়াই অগ্রসর হচ্ছিল, কেননা সেটি ১ম প্যানজার বাহিনীকে সহায়তার জন্যে এর যাত্রাপথ পাল্টে ডন নদীর অপর পার্শ্বে গমন করে। যতক্ষণে ৪র্থ প্যানজার বাহিনী স্টালিনগ্রাড অভিযানে যোগ দিতে ফিরে আসে, ততক্ষণে সোভিয়েত প্রতিরোধ বাহিনী (ভাসিলি চুইকভের নেতৃত্বাধীন ৬২ তম সেনাবাহিনী) একটি শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। ডন নদী পাড়ি দিয়ে জার্মান সৈন্যরা ২৩ আগস্ট ভলগা নদীর তীরে চলে আসলেও ওয়েরমাক্‌ট বাহিনী পরবর্তী ৩ মাস অতিবাহিত করে স্টালিনগ্রাডের সড়ক থেকে সড়কে যুদ্ধ করে।

    দক্ষিণে, ১ম প্যানজার বাহিনী ককেশীয় পর্বতের পাদদেশে ও মাল্কা নদীতে পৌঁছে যায়। আগস্টের শেষে রোমানীয় পার্বত্য সেনারা ককেশীয় আক্রমণকারী বাহিনীর সাথে যোগদান করে, এবং রোমানীয় ৩য় ও ৪র্থ সেনাবাহিনী নিযুক্ত হয় আজভ্ সাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহ শত্রুমুক্ত করার কাজে। তারা স্টালিনগ্রাড নগরীর উভয় প্রান্তে অবস্থান নেয়, যাতে সেখান থেকে জার্মান সেনারা যুদ্ধের মূল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারে। ট্রান্সিলভানিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে অক্ষশক্তির দুই সদস্য রোমানিয়া ও হাঙ্গেরির মধ্যে বিবাদের ফলে অক্ষশক্তির নেতৃত্ব সতর্ক থাকে এবং ডন নদীর বাঁকে অবস্থিত ২য় হাঙ্গেরীয় সেনাবাহিনী থেকে রোমানীয় সেনাবাহিনীকে পৃথক করে নিয়ে আসা হয়, এই কাজ সম্পাদন করে ইতালীয় ৮ম সেনাবাহিনী। এতে করে হিটলারের সকল মিত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে- যার মধ্যে ছিল একটি স্লোভাকীয় বাহিনী যারা ১ম প্যানজার বাহিনীকে সহায়তা করছিল এবং ছিল একটি ক্রোয়েশীয় রেজিমেন্ট যারা জার্মান ৬ষ্ঠ সেনাবাহিনীর সহায়তায় নিযুক্ত ছিল।

    ককেশাস অঞ্চলে অক্ষশক্তির অভিযান স্থবির হয়ে পড়ে, জার্মানরা ম্যালগোবেক নগরী অতিক্রম করতে অক্ষম হয়, তাদের মূল লক্ষ্য, গ্রোজ্‌নি শহর পৌঁছাতে হলে এই নগরী অতিক্রম করা অপরিহার্য ছিল। এর পরিবর্তে তারা গতিপথ পরিবর্তন করে দক্ষিণ প্রান্ত থেকে গ্রোজ্‌নিতে প্রবেশ করার প্রচেষ্টা চালায়। অক্টোবরে তারা মাল্কা নদী পাড়ি দিয়ে উত্তর ওসেটিয়ায় প্রবেশ করে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ওর্দজোনিকিদ্‌যে নগরীর উপকণ্ঠে, ১৩শ প্যানজার ডিভিশনের সম্মুখ সারি আক্রান্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং এতে করে সমগ্র প্যানজার বাহিনীটি পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর সাথে রাশিয়ার অভ্যন্তরে জার্মানদের অভিযানেরও সমাপ্তি ঘটে।

    স্টালিনগ্রাড: ১৯৪২ সালের শীতকালসম্পাদনা

    "অপারেশন ইউরেনাস", "অপারেশন স্যাটার্ন" এবং "অপারেশন মার্স" অভিযানসমূহ: পূর্ব রণাঙ্গনে সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রযাত্রা, ১৮ নভেম্বর, ১৯৪২ থেকে মার্চ, ১৯৪৩ পর্যন্ত:
      ১২ ডিসেম্বর, ১৯৪২ পর্যন্ত
      ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩ পর্যন্ত
      মার্চ, ১৯৪৩ পর্যন্ত (শুধুমাত্র সোভিয়েতদের অধিকৃত অঞ্চল)

    যখন জার্মান ৬ষ্ঠ ও ৪র্থ প্যানজার বাহিনী স্টালিনগ্রাড অভিমুখে যাত্রাপথে যুদ্ধে রত, সেসময় সোভিয়েত সেনাবাহিনী নগরীটির উভয় পাশে অবস্থান নেয়, বিশেষ করে ডন নদীর উপরোস্থ সেতুতে। এবং এই অবস্থান থেকেই ১৯৪২ সালের নভেম্বরে তারা আক্রমণ পরিচালনা করে। "অপারেশন ইউরেনাস" আরম্ভ হয় ১৯ নভেম্বরে, যখন দুটি সোভিয়েত সম্মুখ সারি রোমানীয় সেনাবাহিনীর রক্ষাব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয় এবং ২৩ নভেম্বর কালাচ শহর অভিমুখে যাত্রা করে, এতে করে তারা ৩,০০,০০০ অক্ষশক্তির সেনাদের পেছন থেকে ঘেরাও করে ফেলে।[৮৮] একই সময় রেজেভ সেক্টরে পরিচালিত "অপারেশন মার্স" পরিচালনা করা হয়, যার পরিকল্পনা ছিল স্মোলেন্‌স্ক নগরীর দিকে অগ্রসর হওয়া, তবে তা ব্যর্থ হয় এবং এতে অংশগ্রহণকারী বহু সেনা হতাহত হয়, তারা জার্মানদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে ব্যর্থ হয়।

    জনৈক সোভিয়েত রাজনৈতিক কর্মী (পলিট্রুক) সোভিয়েত সেনাদেরকে জার্মানদের অবস্থানে আক্রমণ চালনার জন্যে উদ্বুদ্ধ করছেন (১২ জুলাই, ১৯৪২)।
    জার্মান পদাতিক বাহিনী ও তাদের সহায়তায় নিয়োজিত একটি স্টাগ-৩ আক্রমণ কামান (StuG III Assault gun), স্টালিনগ্রাড অভিযানের সময়, সেপ্টেম্বর, ১৯৪২।

    জার্মানরা স্টালিনগ্রাড নগরী দখল করতে মরিয়া হয়ে বাড়তি সেনাবহর সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠাতে থাকে, কিন্তু আক্রমণে কোন অগ্রগতি দেখা যায় না, অবশেষে ১২ ডিসেম্বরে স্টালিনগ্রাডে জার্মান ৬ষ্ঠ সেনাবাহিনী অনাহারে পতিত হয় এবং এর থেকে যুদ্ধ করে বের হয়ে আসার মত শক্তি তারা হারিয়ে ফেলে। কোটেলনিকোভো থেকে আকসাই অভিমুখে তিনটি প্যানজার ডিভিশন সমন্বয়ে জার্মানরা "অপারেশন উইন্টার স্টর্ম" পরিচালনা করলেও এই বাহিনীটি তার লক্ষ্য থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরেই থেমে যেতে বাধ্য হয়। জার্মানদের উদ্ধার পরিকল্পনাকে রহিত করতে লাল ফৌজ তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে, তারা ইতালীয় বাহিনীকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে জার্মানদের উদ্ধার অভিযান অপরদিকে ধাবিত হয়; ১৬ ডিসেম্বর তারা এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ চালায়। তবে এই আক্রমণে বাস্তবে তারা যা করতে সফল হয় তা হল, স্টালিনগ্রাডে রসদ সরবরাহকারী জার্মান বিমানগুলো তারা ধ্বংস করে। সোভিয়েতদের এই আক্রমণ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র পরিসরের ছিল, যার মূল লক্ষ্য ছিল রুস্তভ নগরী। এতে হিটলার অবশেষে সম্বিত ফিরে পান এবং যুগ্ম সৈন্যবাহিনী-এ (Army Group A)-কে ককেশাস থেকে প্রত্যাহার করে ডন নদীর নিকটস্থ যুদ্ধে নিযুক্ত করেন।[৮৯]

    ১৯৪৩ সালের ৩১শে জানুয়ারি, জার্মান ৬ষ্ঠ সেনাবাহিনীর মোট ৩,০০,০০০ সৈন্যের মধ্যে মাত্র ৯০,০০০ সদস্য জীবিত থাকে, যারা সোভিয়েতদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। হাঙ্গেরীয় ২য় সেনাবাহিনী সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়। সোভিয়েত লাল ফৌজ ডন নদী থেকে স্টালিনগ্রাডের ৫০০ কিলোমিটার পশ্চিম পর্যন্ত যাত্রা করে, অতঃপর কুর্স্ক নগরী (১৯৪৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পুনরুদ্ধারকৃত) এবং খার্কোভ নগরী (১৯৪৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পুনরুদ্ধারকৃত)-এর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। দক্ষিণে তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে জার্মানরা ফেব্রুয়ারিতে তাদের রেজেভ ঘাঁটি ত্যাগ করে, যাতে ইউক্রেনে পাল্টা আক্রমণ চালানোর জন্যে যথেষ্ট সৈন্য পাওয়া যায়। জেনারেল ম্যানস্টাইনের পাল্টা আক্রমণকে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এস.এস. প্যানজার সেনা এবং তাদের অধিকারে থাকা টাইগার-১ ট্যাংক বহর দ্বারা জোরদার করা হয়। ১৯৪৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারা এই পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং পোল্টাভা থেকে আক্রমণ শুরু করে, মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে তারা পুনরায় খার্কভ নগরীতে ফেরত আসে, যখন বসন্ত কাল এসে পড়ায় তুষার গলতে শুরু করে। এতে করে কুর্স্ক নগরী ও এর আশপাশে অবস্থানরত সোভিয়েত সেনাদের একটি সুবিশাল দল জার্মান অধিকৃত অঞ্চলের মধ্যে আটকা পড়ে যায়।

    কুর্স্কের যুদ্ধ: ১৯৪৩ সালের গ্রীষ্মসম্পাদনা

    সোভিয়েত সৈন্যগণ একটি ৪৫ মি.মি. ক্যালিবার কামান বহন করে নিয়ে যাচ্ছে, ১ আগস্ট, ১৯৪৩।
    খার্কভ ও কুর্স্ক নগরীদ্বয়ে জার্মানদের অবস্থান, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩ থেকে ১ আগস্ট, ১৯৪৩:
      ১৮ মার্চ, ১৯৪৩ পর্যন্ত
      ১ আগস্ট, ১৯৪৩ পর্যন্ত

    স্টালিনগ্রাড নগরী দখলে ব্যর্থ হয়ে হিটলার পরবর্তী মৌসুমের অভিযান পরিকল্পনার দায়িত্ব জার্মান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করে দেন এবং জেনারেল হাইঞ্জ গুডেরিয়ানকে একটি প্রভাবশালী পদে আসীন করেন, তাকে "প্যানজার সেনাবিভাগের পরিদর্শক" পদে দাখিল করা হয়। বাহিনীর সাধারণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়, সোভিয়েতদের কুর্স্ক ঘাঁটি আক্রমণ করা হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে হিটলার নিজেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি জানতেন আক্রমণের মধ্যবর্তী ৬ মাসের মধ্যে সোভিয়েত বাহিনী কুর্স্ক ঘাঁটিতে ট্যাংক-বিধ্বংসী কামান, ট্যাংক-ফাঁদ, ভূমি-মাইন, কাঁটাতারের বেড়া, ঘাঁটির চারপাশ জুড়ে খন্দক, বাংকার, গোলন্দাজ বাহিনী, মর্টার বাহিনী ইত্যাদি সংবলিত কঠিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে।[৯০]

    তবুও, যদি শেষ আরেকবারের মত "ব্লিট্‌জক্রীগ" তথা ঝটিকা আক্রমণ সফলভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে জার্মান বাহিনী পশ্চিম রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনীর ওপর মনোনিবেশ করতে পারত। অবশ্যই, এপ্রিলে অনুষ্ঠিত সমঝোতা বৈঠক কোন সমঝোতায় আসতে পারে নি, পারার কথাও নয়।[৯০] জার্মানদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কুর্স্কের উত্তরে ওরেল ঘাঁটি থেকে এবং দক্ষিণে বেলগোরোড ঘাঁটি থেকে একযোগে হামলা চালানো হবে। উভয় পার্শ্বের সেনারা কুর্স্কের পূর্বদিকে সমবেত হবে, অর্থ্যাৎ ১৯৪১-৪২ সালের শীতকাল আসার পূর্বে "দক্ষিণ যুগ্ম সৈন্যবাহিনী" যে অবস্থানে ছিল সেখানেই তারা পুনঃসংগঠিত হবে।

    প্রোখোরভ্‌কার যুদ্ধটি ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহৎ ট্যাংক যুদ্ধসমূহের মধ্যে অন্যতম, এটি বৃহত্তর "কুর্স্কের যুদ্ধের" অন্তর্গত।

    উত্তরে সম্পূর্ণ জার্মান ৯ম সেনাবাহিনীকে রেজেভ ঘাঁটি থেকে ওরেল ঘাঁটিতে স্থানান্তর করা হয়, এবং তাদেরকে মালোয়ারখাংগেলস্ক থেকে কুর্স্ক পর্যন্ত যাত্রা করার আদেশ দেয়া হয়। কিন্তু যাত্রা শুরুর ৮ কিলোমিটার দূরেই তাদের প্রথম লক্ষ্য ওলখোভাটকা নগরীও তারা অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়। ৯ম সেনাবাহিনীর সম্মুখভাগ সোভিয়েত মাইনক্ষেত্রে পতিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এস্থানের উচ্চভূমিই ছিল কুর্স্ক পর্যন্ত বিস্তৃত সমতল ভূমির আগের একমাত্র প্রাকৃতিক বাধা। এর ফলে তারা গতিপথ পরিবর্তন করে ওলখোভাটকা থেকে পশ্চিমে পোনিরি দিয়ে যাত্রা করে। তবে এস্থানটিও ৯ম সেনাবাহিনী অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয় এবং প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়। লাল ফৌজ তখন তাদের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়, যা ছিল "অপারেশন কুটুজভ"।

    ১২ জুলাই লাল ফৌজ ঝিজরা নদীতে অবস্থিত ২১১তম এবং ২৯৩তম ডিভিশনের মধ্যবর্তী চিহ্নিতকরণ রেখা অতিক্রম করে আক্রমণ চালায় এবং কারাচেভ নগরী অভিমুখে দ্রুতবেগে অগ্রসর হতে থাকে, যা ছিল তাদের এবং ওরেল নগরীর ঠিক পশ্চাতে। জার্মানদের দক্ষিণ আক্রমণটি অপেক্ষাকৃত সাফল্য লাভ করে, এর সম্মুখভাগে ছিল জেনারেল হার্মান হথের নেতৃত্বাধীন ৪র্থ প্যানজার বাহিনী, যার অন্তর্গত ছিল ৩টি ট্যাংক কোর। ডনেট্‌স নদীর উভয়পাশে সংকীর্ণ পথ দিয়ে জার্মানদের দুটি বাহিনী, "২য় এস.এস. প্যানজার কোর" এবং "গ্রসডইচল্যান্ড প্যানজার গ্রেনেডিয়ার ডিভিশন" আক্রমণ চালিয়ে মাইনক্ষেত্র ও উচ্চভূমি সংবলিত ভূখণ্ড দিয়ে ওবোয়ান শহর অভিমুখে অগ্রসর হয়। কঠিন প্রতিরোধের মুখে তারা বারংবার দিক পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়, কিন্তু ট্যাংক বাহিনীসমূহ ২৫ কি.মি. অগ্রসর হতে সক্ষম হয়, সেখানে তারা প্রোখোরভকা নগরীর বাইরে "সোভিয়েত ৫ম গার্ড ট্যাংক" বাহিনীর সম্মুখীন হয়। এস্থানে ১২ জুলাই তুমুল লড়াই চলে, যাতে দুই পক্ষের প্রায় এক হাজার ট্যাংক অংশগ্রহণ করে।

    যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইতিহাসবিদগণ প্রোখোরভ্‌কার যুদ্ধকে ইতিহাসের বৃহত্তম ট্যাংক যুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেন। এই যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনী সফলভাবে জার্মানদের রুখে দেয়, যদিও এর জন্যে তারাও ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। ৫ম সোভিয়েত গার্ড ট্যাংক বাহিনীর প্রায় ৮০০টি হালকা ও মধ্যম ট্যাংক এ যুদ্ধে নিযুক্ত হয় এবং জার্মান ২য় এস.এস. প্যানজার কোরের ট্যাংক বাহিনীর একাংশ এতে অংশ নেয়। উভয় পক্ষের কয়টি ট্যাংক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। যদিও সোভিয়েত ৫ম গার্ড ট্যাংক বাহিনী তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে ব্যর্থ হয়, তবুও জার্মানদের অগ্রযাত্রা তারা পুরোপুরি থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

    দিনশেষে উভয় বাহিনীই একে অপরকে সম্পূর্ণভাবে স্থবির করে দেয়, তবে উত্তরে জার্মানদের ব্যর্থতা সত্ত্বেও জেনারেল এরিখ ফন ম্যানস্টাইন ৪র্থ প্যানজার বাহিনীর আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। লাল ফৌজ উত্তর ওরিয়েল ঘাঁটিতে শক্ত আক্রমণ চালিয়ে জার্মান ৯ম সেনাবাহিনীর রক্ষাব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়। তদুপরি ১০ জুলাইয়ে মিত্রবাহিনী সিসিলীতে অবতরণ নিয়ে হিটলার উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি ৯ম সেনাবাহিনীকে সোভিয়েত আক্রমণ প্রতিরোধ করার আদেশ দেন, যদিও তারা ক্রমেই পিছু হটছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মানদের শেষ আক্রমণাত্মক রণকৌশলের সমাপ্তি ঘটে সোভিয়েত পাল্টা আক্রমণ প্রতিরোধের মাধ্যমে, যা আগস্ট মাস পর্যন্ত চলতে থাকে।

    কুর্স্ক আক্রমণ ছিল ১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে জার্মান বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত আক্রমণসমূহের শেষটি। এর পরবর্তীতে জার্মানরা যেসমস্ত আক্রমণ চালায় তা তাদের পূর্বের তুমুল শক্তিশালী আক্রমণসমূহের ছায়ামাত্র।

    ১৯৪৩-৪৪ সালের শরৎ ও শীতকালসম্পাদনা

    "কাটিয়ুশা", সোভিয়েতদের একটি উল্লেখযোগ্য রকেট লঞ্চার।

    ওরেল ঘাঁটি আক্রমণের মাধ্যমে আরম্ভ হয় সোভিয়েতদের গ্রীষ্মকালীন অভিযান, যা কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। অপেক্ষাকৃত উন্নত যুদ্ধ-সরঞ্জামে সজ্জিত "গ্রসডইচল্যান্ড ডিভিশন"কে বেলগোরোড থেকে কারাচেভ নগরীর দিকে গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় এবং এর কৌশলগত ক্ষতি তারা সামাল দিতে পারে নি। এর ফলে জার্মান সেনাবাহিনী ওরেল ঘাঁটি ছেড়ে পিছু হটতে থাকে, ১৯৪৩ সালের ৫ আগস্ট লাল ফৌজ ওরেল ঘাঁটির কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। জার্মান বাহিনী ব্রিয়ানস্ক নগরীর সম্মুখে হেগেন রেখার পর্যন্ত তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। দক্ষিণে লাল ফৌজ "জার্মান দক্ষিণ বাহিনীর" বেলগোরোড অবস্থান আক্রমণ করে তাদের প্রতিরোধ ভেঙে দিতে সক্ষম হয় এবং খার্কোভ নগরী অভিমুখে পুনরায় যাত্রা শুরু করে। যদিও জুলাই মাসজুড়ে তুমুল ট্যাংক লড়াইয়ে জার্মান টাইগার-১ ট্যাংক বাহিনী সোভিয়েত ট্যাংক আক্রমণসমূহকে থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়, কিন্তু পেসেল ঘাঁটি থেকে আগত সোভিয়েত বাহিনীও আক্রমণ শুরু করলে জার্মানরা তাদের উভয়পাশ থেকে আক্রমণের শিকার হয়। অবশেষে ২২ আগস্ট জার্মান বাহিনী খার্কোভ নগরী শেষবারের মত ত্যাগ করে পিছু হটে যায়।

    মিউস নদীর তীরে অবস্থিত জার্মান বাহিনী, যাতে ছিল ১ম প্যানজার বাহিনী ও পুনর্গঠিত ৬ষ্ঠ সেনাবাহিনী, নিজেদের অবস্থানে সোভিয়েত আক্রমণ ঠেকানোর মত শক্তি তাদের ছিল না। লাল ফৌজ তাদের উপর হামলা চালালে তারা পিছু হটে ডনবাস শিল্প অঞ্চল হয়ে নীপার নদী পর্যন্ত চলে যায়, এতে তারা অধিকৃত কৃষিভূমির অর্ধেকের কর্তৃত্বই হারায়, যে কারণে তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছিল। এ পর্যায়ে হিটলার নীপার নদী পর্যন্ত সেনা প্রত্যাহার করে নিতে রাজি হন, যেখানে "ওস্টওয়াল" নির্মানের পরিকল্পনা ছিল, যা ছিল জার্মান-ফরাসি সীমান্তে নির্মিত "সিগফ্রেড লাইন" বা "ওয়েস্ট-ওয়াল"-এর অনুরূপ সারিবদ্ধ দুর্গ ও অপরাপর প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনা।

    "ওয়েরমাক্‌ট"-এর প্রধান সমস্যা ছিল যে, এই প্রতিরক্ষা স্থাপনাসমূহ তখনও নির্মিত হয়নি; সেপ্টেম্বর মাসে যখন দক্ষিণ যুগ্ম বাহিনী পূর্ব ইউক্রেন ত্যাগ করে নীপার নদী পারাপার হচ্ছিল, ততদিনে সোভিয়েত বাহিনী তাদের নাগাল পেয়ে যায়। বহুকষ্টে সৈন্যরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে দাঁড়-টানা নৌকায় চড়ে ৩ কি.মি. প্রশস্ত এই নদী পার হয় এবং নদীর অপর পাড়ে একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। লাল ফৌজ তাদের কাছ থেকে এই ভূমির দখল নিতে দ্বিতীয়বার আক্রমণ চালায়, কানিভ শহরে ২৪ সেপ্টেম্বর প্যারাস্যুটে করে সোভিয়েত সৈন্যেরা অবতরণ করার চেষ্টা চালায়, তবে তাদের এ আক্রমণ ব্যর্থ হয়। তবে প্যারাস্যুট হামলা ঠেকাতে জার্মানদের কিছুটা সময় ব্যয় হয়, এ সুযোগে লাল ফৌজের অন্যান্য সৈন্যেরা নির্বিঘ্নে অগ্রসর হবার সুযোগ পায়, তারা নীপার নদী পাড়ি দিয়ে অপর পাড়ে ঘাঁটি গড়তে সক্ষম হয়।

    সেপ্টেম্বরের শেষে এবং অক্টোবরের শুরুতে, নীপার নদীতীরে একের পর এক সোভিয়েত সৈন্যদলের আক্রমণে এ অবস্থান ধরে রাখা জার্মান বাহিনীর পক্ষে অসাধ্য হয়ে পড়ে। তারা নীপারের তীরবর্তী শহরগুলোর কর্তৃত্ব একের পর এক হারাতে থাকে। প্রথমে জাপোরোজি নগরী অতঃপর নেপ্রোপেট্রোভস্ক নগরীর কর্তৃত্ব তারা হারায়। অবশেষে, নভেম্বরে লাল ফৌজ কিয়েভের উভয় পাশে সেতু-ঘাঁটিদ্বয় দখল করে নেয় এবং ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ নগরী দখল করে নেয়, যা ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ৩য় বৃহত্তম নগরী।

    কিয়েভ থেকে ৮০ মাইল পশ্চিমে, ৪র্থ প্যানজার বাহিনী তখনও ভাবতে থাকে লাল ফৌজ একটি বিধ্বস্ত বাহিনী, তারা নভেম্বরের মধ্যভাগে জিটোমির নগরী পুনর্দখলে সক্ষম হয়, তেতেরেভ নদীর তীরে এস.এস. প্যানজার বাহিনীর এক দুঃসাহসী হামলায় সোভিয়েতদের সেতু পার্শ্ববর্তী অবস্থান দূর্বল হয়ে পড়ে। এতে করে জার্মান দক্ষিণ যুগ্ম বাহিনী কোরোস্টেন নগরীও পুনর্দখল করতে সক্ষম হয় এবং সাময়িক একটি অবকাশ পায়। তবে, একই অঞ্চলে বড়দিনের প্রাক্কালে ১ম ইউক্রেনীয় সেনাবিভাগ (প্রাক্তন ভোরোনেজ সেনাবিভাগ)-এর আক্রমণে জার্মান বাহিনী পুনরায় পিছু হটতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত বাহিনীর এ অগ্রযাত্রা অব্যহত থাকে ১৯৪৪ সালের ৩ জানুয়ারিতে তারা পোলিশ-সোভিয়েত সীমান্তে (১৯৩৯ সালের সীমান্ত) পৌঁছানো পর্যন্ত।

    দক্ষিণে ২য় ইউক্রেনীয় সেনাবিভাগ (প্রাক্তন স্টেপ সেনাবিভাগ) ক্রেমেনচাগ নগরীতে নীপার নদী পার হয়ে পশ্চিম অভিমুখে যাত্রা করে। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে তারা উত্তরদিকে মোড় নিয়ে কমান্ডার ভাটুটিনের নেতৃত্বাধীন ট্যাংক বাহিনীর সাথে মিলিত হয়, যারা পোল্যান্ডে প্রবেশ করে দক্ষিণে মোড় নিয়েছিল, এই সম্মিলিত বাহিনী কোর্সুন-শেভচেঙ্কোভস্কি শহরে ১০টি জার্মান ডিভিশনকে ঘেরাও করে ফেলে, যা ছিল ইউক্রেনের চেরকাসি নগরীর পশ্চিমে। হিটলার বারংবার জোর দিতে থাকেন নীপার রেখাটির কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যে, এমনকি যখন তার বাহিনী নিশ্চিত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখনই তিনি তার মত পাল্টাননি। তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন যে, চেরকাসিতে অবস্থিত তার বাহিনী এই অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম এবং কিয়েভ আক্রমণও তাদের দ্বারা সম্ভব, কিন্তু জেনারেল ম্যানস্টাইন চিন্তিত ছিলেন কীকরে অবরোধকৃত ঘাঁটি পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে ঘাঁটিতে আটকে পড়া সেনাদের পলায়নে সহায়তা করা যায়।

    ১৬ই ফেব্রুয়ারিতে এই পরিকল্পনার প্রথম ভাগ সফলভাবে সম্পন্ন করা যায়, ক্রমে সংকুচিত চেরকাসি ঘাঁটি থেকে প্যানজার বাহিনীকে নিলয়-টিকিচ নদীপথে বের করে নিয়ে আসা হয়। সোভিয়েতদের গোলাবর্ষণ ও সোভিয়েত ট্যাংক বাহিনীর ধাওয়ার মুখে অবরোধকৃত জার্মান সৈন্যরা যুদ্ধ করতে করতে নদী পার হয়ে আসে, যদিও তাদের অর্ধেক সৈন্যই হতাহত হয় এবং তাদের অস্ত্র-সরঞ্জামের অধিকাংশই ঘাঁটিতে ফেলে আসতে হয়। পলায়নরত জার্মান বাহিনীর মধ্যে অন্যতম ছিল ৫ম এস.এস. প্যানজার ডিভিশন- "ভাইকিং"। তখন বসন্ত এসে পড়ায়, তারা ধারণা করেছিল লাল ফৌজ এরপর তাদেরকে আর আক্রমণ করতে যাবে না। কিন্তু ৩ মার্চ সোভিয়েত ইউক্রেনীয় সেনাবিভাগ পুনরায় আক্রমণ চালায়। মার্শাল ম্যালিনভস্কির নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত বাহিনী সংকীর্ণ পেরেকপ ভূখণ্ড দখল করে ক্রিমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং প্রুট নদীতে না থেমে তারা কাদাপূর্ণ সীমান্তভূমি পেরিয়ে রোমানিয়ায় অনুপ্রবেশ করে।

    ১ আগস্ট, ১৯৪৩ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৪ পর্যন্ত সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রযাত্রা:
      ডিসেম্বর, ১৯৪৩ পর্যন্ত
      ৩০ এপ্রিল, ১৯৪৪ পর্যন্ত
      ১৯ আগস্ট, ১৯৪৪ পর্যন্ত
      ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৪ পর্যন্ত

    ১৯৪৩-৪৪ মৌসুমের অভিযানের সমাপ্তি হয় শেষ একটি যাত্রার মাধ্যমে, যা ছিল ৫০০ মাইলব্যপী সোভিয়েত বাহিনীর যাত্রার শেষ পর্যায়। মার্চে কামেনেট্‌স-পোডোলস্কি নগরীর কাছে জার্মান জেনারেল হান্স-ভালেটিন হুবের নেতৃত্বাধীন ১ম প্যানজার বাহিনীর ২০ডিভিশন সৈন্য অবরোধের সম্মুখীন হয়, যা "হুব অবরোধ" নামে পরিচিত। দুই সপ্তাহ ব্যপী তুমুল যুদ্ধের পর, ১ম প্যানজার বাহিনী এই অবরোধ ভেঙে মুক্ত হতে সক্ষম হয়, তবে এ যুদ্ধে তাদের প্রায় সকল ভারি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম খোয়া যায়। এই পর্যায়ে হিটলার জেনারেল ম্যানস্টাইনসহ তার কয়েকজন স্বনামধন্য জেনারেলকে পদচ্যুত করেন। এপ্রিলে লাল ফৌজ ওডেসা নগরী দখল করে নেয়, এর পর ৪র্থ ইউক্রেনীয় সেনাবিভাগ ক্রিমিয়া অধিকার করার অভিযান চালায়, যা তারা সফলভাবে সম্পন্ন করে মে মাসের ১০ তারিখে বন্দরনগরী সেভাস্টপুল দখলের মাধ্যমে।

    জার্মান "কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনী" (Army Group Centre) ১৯৪৩ সালের আগস্ট মাসে হেগেন রেখা থেকে ধীরে ধীরে পিছু হটতে থাকে, তারা অপেক্ষাকৃত কম অঞ্চলেরই দখল হারায়। কিন্তু ব্রিয়ানস্ক নগরী এবং ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ স্মোলেনস্ক নগরী হাতছাড়া হওয়াতে ২৫ সেপ্টেম্বর "ওয়েরমাক্‌ট" তাদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা স্থাপনাসমূহ হারায়। তাদের ৪র্থ ও ৯ম সেনাবাহিনী ও ৩য় প্যানজার বাহিনী তখনও নীপার নদীর উত্তর ভাগের দখল বজায় রেখেছিল। এবং সোভিয়েত বাহিনীকে তারা ভিটেভস্ক নগরী পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয় নি। জার্মান "উত্তর যুগ্ম বাহিনী" এতদিন উল্লেখযোগ্য কোন যুদ্ধের সম্মুখীন হয়নি, তবে ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে হঠাৎ করেই তারা সোভিয়েতদের ভোলকোভ সেনাবিভাগ ও বাল্টিক সেনাবিভাগের অতর্কিত আক্রমণের সম্মুখীন হয়।[৯১]

    সোভিয়েতদের ঝটিকা অভিযানে জার্মানরা সুদূর লেনিনগ্রাড থেকে বিতাড়িত হয় এবং নভ্‌গরড অঞ্চল সোভিয়েত বাহিনীর দখলে চলে আসে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৭৫ মাইল এলাকা অগ্রসর হবার পর লেনিনগ্রাড সেনাবিভাগ এস্তোনিয়া সীমান্তে পৌঁছে যায়। স্টালিনের মনে করেন, পূর্ব প্রুশিয়ার জার্মান ভূমিতে যুদ্ধ অভিযান চালাবার জন্যে এবং ফিনল্যান্ড দখল করার জন্যে বাল্টিক সাগরপথেই সর্বাপেক্ষা দ্রুত যাতায়াত করা যাবে।[৯১] তবে, ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাল্টিক সাগরের উপকূলবর্তী এস্তোনিয়ার রাজধানী টালিন নগরীর যুদ্ধে লেনিনগ্রাড সেনাবিভাগের আক্রমণ থামিয়ে দেয়া হয়। জার্মান সৈন্যবিভাগ "নারওয়া"তে অন্তর্ভুক্ত ছিল এস্তোনিয়ান সেনারা, যারা তাদের রাষ্ট্র এস্তোনিয়ার স্বাধীনতা বজায় রাখার যুদ্ধে অংশ নেয়।[৯২][৯৩]

    ১৯৪৪ সালের গ্রীষ্মকালীন যুদ্ধসম্পাদনা

    বুখারেস্ট নগরীতে লাল ফৌজ সেনাদের অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে, আগস্ট, ১৯৪৪।
    ভিলনিয়াস নগরীতে সোভিয়েত ও পোলিশ "আর্মিয়া ক্রাজোয়া" বাহিনীর সৈন্যগণ, জুলাই, ১৯৪৪।

    "ওয়েরমাক্‌ট"-এর পরিকল্পনাকারীরা এই বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে লাল ফৌজ দক্ষিণে পুনরায় আক্রমণ চালাবে, যেখানে যুদ্ধের সম্মুখ সারি ছিল লেভিভ নগরী থেকে মাত্র ৫০ মাইল দূরএ যা ছিল বার্লিন অভিমুখে যাত্রার সবচেয়ে সহজ পথ। এই ধারণা অনুযায়ী তারা কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনী থেকে কিছু সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়, যারা তখনো সোভিয়েত অধিকৃত অঞ্চলের গভীরে অবস্থান করছিল। এরও দুই সপ্তাহ পূর্বে জার্মানরা মিত্রবাহিনীর নরম্যান্ডি আক্রমণ প্রতিহত করতে সেনাবাহিনীর কিছু অংশকে ফ্রান্সে স্থানান্তর করে। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত মিত্রবাহিনীর তেহরান সম্মেলনে "অপারেশন ব্যাগ্রেশন" পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যে অভিযানে ১৯৪৪ সালের ২২শে জুন তারিখে, সোভিয়েত বাহিনীর ৪টি যুগ্ম সেনাবাহিনীর ১২০টি ডিভিশন সংবলিত একটি বিশাল বাহিনী বেলারুশে অবস্থিত জার্মান বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

    তাদের প্রকাণ্ড এ আক্রমণটি জার্মান কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনীকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়, যদিও জার্মানদের ধারণা ছিল উত্তর যুগ্ম বাহিনীর ওপর হামলা হতে পারে। ২৩ লক্ষাধিক সোভিয়েত সৈন্য জার্মান কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনীকে হামলা করে, যাদের লোকবল ছিল ৮ লক্ষেরও কম। সোভিয়েত বাহিনী সংখ্যায় ও গুণগত মানে অত্যধিকভাবে জার্মানদের ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া সোভিয়েত ট্যাংকের সংখ্যা জার্মানদের তুলনায় ১০ গুণ এবং যুদ্ধবিমানের সংখ্যা জার্মানদের তুলনায় ৭ গুণ বেশি থাকে। জার্মানরা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে। বেলারুশের রাজধানী মিন্‌স্ক নগরী সোভিয়েত বাহিনী ৩ জুলাই তারিখে দখল করে নেয়, প্রায় ১ লক্ষ জার্মান সেনা নগরীর ভেতরে আটকা পড়ে। এর দশ দিন পর লাল ফৌজ যুদ্ধ পূর্ববর্তী পোলিশ সীমান্তে পৌঁছে যায়। "অপারেশন ব্যাগ্রেশন" ছিল যুদ্ধের সর্ববৃহৎ একক অভিযানগুলোর মধ্যে অন্যতম।

    ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে জার্মানদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় এরূপ- ৪,০০,০০০ নিহত, আহত, নিখোঁজ কিংবা অসুস্থ; যার মধ্যে ১,৬০,০০০ যুদ্ধবন্দী; ২,০০০ ট্যাংক এবং ৫৭,০০০ অন্যান্য যানবাহন ধ্বংসপ্রাপ্ত। উপর্যুক্ত অভিযানে সোভিয়েতদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ- ১,৮০,০০০ নিহত কিংবা নিখোঁজ (আহত ও অসুস্থ মিলে মোট ৭,৬৫,৮১৫ জন, এবং ৫,০৭৩ জন পোলিশ হতাহত);[৯৪] এছাড়া ২,৯৫৭টি ট্যাংক ও কামান বিধ্বস্ত। এস্তোনিয়া আক্রমণে আরো ৪,৮০,০০০ সোভিয়েত সৈন্য হতাহত হয়, যার মধ্যে ১,০০,০০০ সৈন্যকে নিহত ঘোষণা করা হয়।[৯৫][৯৬]

    এর পাশাপাশি পরিচালনা করা হয় "লেভোভ- স্যান্ডোমিয়ার্জ অপারেশন", যা শুরু হয় ১৯৪৪ সালের ১৭ জুলাই, এ অভিযানে লাল ফৌজ পশ্চিম ইউক্রেনে অবস্থানরত জার্মান বাহিনীকে পরাস্ত করে এবং লেভিভ নগরী দখল করে। অতঃপর সোভিয়েত বাহিনী আরো দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে রোমানিয়ায় অনুপ্রবেশ করে (১৯৪৪)। ইতোপূর্বে, ২৩ আগস্টে রোমানিয়ার অক্ষশক্তি-সমর্থক সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। লাল ফৌজ রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট দখল করে ৩১ আগস্টে। ১২ সেপ্টেম্বর রোমানিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সাক্ষর করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

    জেলগাভা নগরীর সড়ক পথ ধরে সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রযাত্রা, ১৯৪৪ সালের গ্রীষ্মকাল।

    "অপারেশন ব্যাগ্রেশন"-এর দ্রুত অগ্রগতির ফলে জার্মান উত্তর যুগ্ম বাহিনী এর অপরাপর বাহিনীসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা জাগে, একারণে তারা প্রাণপণে টালিন অভিমুখে সোভিয়েতদের অগ্রসরকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এস্তোনিয়ার সিনিমেড পাহাড়ে "নারওয়ার যুদ্ধে" তুমুল লড়াইয়ের পরও সোভিয়েত বাহিনী তাদের থেকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকারের জার্মান "নারওয়া সৈন্যদল"কে পরাস্ত করতে অক্ষম হয়, এ অঞ্চলের অসমতল ভূমি বড় আকারের আক্রমণ চালানোর উপযুক্ত ছিল না।[৯৭][৯৮]

    ১৯৪৪ সালের ৯ই জুন, কারেলিয়ান সংকীর্ণ ভূমিখণ্ডে (Isthmus) লাল ফৌজ ফিনিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায় (ভাইবোর্গ-পেট্রোজাভোস্ক আক্রমণ), যা মিত্রবাহিনীর নরম্যান্ডি আক্রমণের সাথে পরিকল্পিতভাবে একই সময়ে পরিচালিত হয়। ফিনদের বিরুদ্ধে সোভিয়েতদের তিনটি সেনাবাহিনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, যাদের মধ্যে ছিল বহু অভিজ্ঞ রাইফেলধারী রক্ষীদল। ১০ জুন সোভিয়েতগণ ভালকেসারি অঞ্চলে ফিনিশদের সম্মুখ সারির (ভি.টি.-লাইন) রক্ষাব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়। সোভিয়েত আক্রমণে সহায়তা করার জন্যে ছিল গোলন্দাজ বাহিনীর ভারি গোলাবর্ষণ, বিমান হামলা এবং ট্যাংক বাহিনী। ১৪ জুন কুটারসেল্কায় ফিনিশ ট্যাংক ডিভিশন কর্তৃক পাল্টা আক্রমণ ব্যর্থ হলে ভি.টি.-লাইনের পতন ঘটে। ফলে ফিনিশ বাহিনী পিছু হটে ভি.কে.টি.-লাইনে অবস্থান নেয়। এর পরবর্তী টালি-ইহানটালার যুদ্ধ ও ইলোমান্তসির যুদ্ধে তুমুল লড়াইয়ের পর ফিনিশ সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত বাহিনীকে রুখে দিতে সক্ষম হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

    পোল্যান্ড অভিমুখে লাল ফৌজ অগ্রসর হলে, পোলিশ আভ্যন্তরীণ সেনাবাহিনী (এ.কে.) নাৎসিদের বিরুদ্ধে "অপারেশন টেমপেস্ট" পরিচালনা করে। "ওয়ারশ' অভ্যুত্থানের" সময় লাল ফৌজ ভিস্টুলা নদীর নিকটে এসে থেমে যায়। পোলিশদের যুদ্ধে সাহায্য করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই তাদের ছিল না।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

    ১৯৪৪ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে, স্লোভাকিয়ায় জার্মান ওয়েরমাক্‌ট সেনা ও স্লোভাক বিদ্রোহী সেনাদের মধ্যে সংঘটিত হয় সশস্ত্র "স্লোভাক জাতীয় অভ্যুত্থান"। এর কেন্দ্র ছিল বানস্কা বিস্ট্রিকা নগরীতে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

    ১৯৪৪ সালের শরত্কালসম্পাদনা

    ১৫ নভেম্বর, ১৯৪১ থেকে ১৫ এপ্রিল ১৯৪২ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ ৩০ লক্ষাধিক জার্মান ও অক্ষশক্তির সৈন্যদের "পূর্ব রণাঙ্গন পদক" প্রদান করা হয়। এই পদকের ডাকনাম দেয়া হয় "হিমায়িত-মাংস পদক"। [৯৯]

    ১৯৪৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর লাল ফৌজ স্লোভাক-পোলিশ সীমান্তের ডুকলা পাসে আক্রমণ চালায়। এর দুই মাসের মাথায় সোভিয়েত বাহিনী এই যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং স্লোভাকিয়ায় প্রবেশ করে। তবে এর জন্যে তাদের উচ্চমূল্য দিতে হয়, যুদ্ধে ২০,০০০ লাল ফৌজ সৈন্য নিহত হয়, এছাড়াও বিপুল সংখ্যক জার্মান, স্লোভাক ও চেক সৈন্য প্রাণ হারায়।

    সোভিয়েত বাহিনীর বাল্টিক আক্রমণের মুখে, জার্মান উত্তর যুগ্ম বাহিনীকে প্রত্যাহার করে বাল্টিক অঞ্চলে সারেমা, কোরল্যান্ড ও মেমেল নগরীতে মোতায়েন করা হয়।

    জানুয়ারি-মার্চ, ১৯৪৫সম্পাদনা

    ১ জানুয়ারি, ১৯৪৫ থেকে ১১ মে, ১৯৪৫ পর্যন্ত সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রযাত্রা:
      ৩০ মার্চ, ১৯৪৫ পর্যন্ত
      ১১ মে, ১৯৪৫ পর্যন্ত

    ১৯৪৫ সালের ১৭ই জানুয়ারিতে অবশেষে সোভিয়েত বাহিনী পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস'তে প্রবেশ করে, জার্মান বাহিনী তার পূর্বেই এই শহর ধ্বংস করে পিছু হটে যায়। তিন দিনব্যপী ৪টি সোভিয়েত সেনাবাহিনী বিস্তৃতভাবে আক্রমণ চালায়। লাল ফৌজ নারিউ নদী এবং ওয়ারস' নগরী থেকে তাদের ভিস্টুলা-ওডার আক্রমণ পরিচালনা করে। সংখ্যাধিক্যে সোভিয়েতরা সকলক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল, সোভিয়েত বাহিনী ও জার্মানদের সংখ্যা অনুপাত ছিল এরূপ- সৈন্য ৫-৬:১, গোলন্দাজ বাহিনী ৬:১, ট্যাংক ৬:১, চলমান কামান ৪:১। চার দিনের মাথায় লাল ফৌজ যাত্রা শুরু করে এবং প্রতিদিন ত্রিশ থেকে চল্লিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে থাকে। তারা বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ, দানজিগ, পূর্ব প্রুশিয়া, পোজনান দখল করে নেয় এবং বার্লিনের ৬০ কিলোমিটার দূরে ওডার নদীর ধারে তাদের সম্মুখ সারি দাঁড় করায়। ভিস্টুলা-ওডার অভিযানের সমগ্র স্থায়িত্বকাল জুড়ে (২৩ দিন) সোভিয়েত বাহিনী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১,৯৪,১৯১ জন (নিহত, আহত ও নিখোঁজ) এবং ১,২৬৭টি ট্যাংক ও কামান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

    ১৯৪৫ সালের ২৫ জানুয়ারি হিটলার তিনটি যুগ্ম সেনাবাহিনী (Army group) গঠন করেন। "উত্তর যুগ্ম বাহিনী"কে বানানো হয় "কোরল্যান্ড যুগ্ম বাহিনী", "কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনী"কে বানানো হয় "উত্তর যুগ্ম বাহিনী" এবং "যুগ্ম বাহিনী-এ" পরিণত হয় "কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনী"তে। পুরাতন কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনীকে ক্ষুদ্রতর একটি দলে পরিণত করে পূর্ব প্রুশিয়ার কোনিগ্‌সবার্গে স্থাপন করা হয়।

    পূর্ব প্রুশিয়ার জার্মান শরণার্থীরা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫।

    "রাইখ্‌সফিউরার" হেনরিখ হিমলারের নেতৃত্বে নবগঠিত "ভিস্টুলা যুগ্ম বাহিনী" ক্ষুদ্র পরিসরে একটি পাল্টা আক্রমণ চালায়, (সাংকেতিক নাম: "অপারেশন সোল্‌স্টিস")। তবে ২৪ ফেব্রুয়ারি এই আক্রমণ ব্যর্থ হয়; লাল ফৌজ পমেরানিয়া অঞ্চলে অগ্রসর হতে থাকে এবং ওডার নদীর পূর্ব তীর শত্রুমুক্ত করে। দক্ষিণে বুদাপেস্ট নগরীতে আটকা পড়া সৈন্যদের উদ্ধারে জার্মান বাহিনী "অপারেশন কনরাড" পরিচালনা করে, যা ব্যর্থ হয় এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি এ শহরেরও পতন হয় সোভিয়েত বাহিনীর হাতে। ৬ই মার্চ জার্মানরা তাদের ২য় বিশ্বযুদ্ধের সর্বশেষ আক্রমণ পরিচালনা করে, "অপারেশন বসন্ত অভ্যুত্থান", যা ১৬ই মার্চের মধ্যে ব্যর্থ হয়। ৩০ মার্ট লাল ফৌজ অস্ট্রিয়া অনুপ্রবেশ করে এবং ১৩ এপ্রিল রাজধানী ভিয়েনা দখল করে নেয়।

    জার্মান সামরিক কর্তৃপক্ষের হিসাবমতে ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব রণাঙ্গনে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ- ৭৭,০০০ নিহত, ৩,৩৪,০০০ আহত এবং ২,৯২,০০০ নিখোঁজ (মোট ক্ষয়ক্ষতি ৭,০৩,০০০ জন)।[১০০]

    ১৯৪৫ সালের ৯ই এপ্রিল অবশেষে পূর্ব প্রুশিয়ার পতন হয় লাল ফৌজের নিকটে, যদিও ভিস্টুলা উপদ্বীপ ও হেল উপদ্বীপে জার্মান কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনীর অবশিষ্ট সেনারা ইউরোপে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায়। পূর্ব প্রুশিয়ার অভিযানটি ছিল লাল ফৌজের সমগ্র যুদ্ধকালীন সবচেয়ে বড় ও ক্ষতিসাধ্য সংঘাতসমূহের মধ্যে অন্যতম, যদিও এ সংঘাত "ভিস্টুলা-ওডার অপারেশন" ও পরবর্তী বার্লিনের যুদ্ধের আড়ালে পড়ে যায়। এই যুদ্ধ চলাকালীন (১৩ জানুয়ারি - ২৫ এপ্রিল) লাল ফৌজের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৫,৮৪,৭৮৮ জন সৈন্য, এবং ৩,৫২৫টি ট্যাংক ও কামান।

    কোনিগ্‌সবার্গের পতনের পর সোভিয়েত সামরিক কর্তৃপক্ষ স্টাভ্‌কা জেনারেল কনস্টান্টিন রোকোসোভস্কির নেতৃত্বাধীন ২য় বেলারুশীয় সৈন্যবিভাগকে (২-বি.এফ.) স্থানান্তর করে ওডার নদীর তীরে নিয়ে আসে। এপ্রিলের প্রথম দুই সপ্তাহে লাল ফৌজ তাদের যুদ্ধকালীন সবচেয়ে দ্রুত সৈন্য স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পাদন করে। জেনারেল জর্জি জুকভ তার নেতৃত্বাধীন ১ম বেলারুশীয় সেন্যবিভাগকে (১-বি.এফ.) বাল্টিক সাগরের দক্ষিণে সিলো হাইট্‌স অঞ্চলে স্থাপন করেন, যারা এর পূর্বে ওডার নদীর ধারে ফ্রাঙ্কফুর্ট নগরীতে অবস্থান করছিল। এই সৈন্য স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় সম্মুখ সারিতে ফাঁক সৃষ্টি হয়, যার সুযোগ নিয়ে জার্মান ২য় সেনাবাহিনীর অবশিষ্টাংশ, যারা দানজিগে আটকা পড়েছিল, তারা ওডার নদী পার হয়ে পালাতে সক্ষম হয়। দক্ষিণে জেনারেল ইভান কোনেভ তার নেতৃত্বাধীন ১ম ইউক্রেনীয় সৈন্যবিভাগ (১-ইউ.এফ.)-কে উচ্চতর সাইলেসিয়া অঞ্চল থেকে উত্তর-পশ্চিমে সরিয়ে নাইস নদীর নিকটে নিয়ে আসেন।[১০১] এই তিন সোভিয়েত সৈন্যবিভাগে মোট ২৫ লক্ষ সৈন্য ছিল (যার মধ্যে ১ম পোলিশ সেনাবাহিনীর ৭৮,৫৫৬ জন সেনা ছিল); এছাড়া তাদের সাথে ৬,২৫০টি ট্যাংক, ৭,৫০০টি বিমান, ৪১,৬০০টি কামান ও মর্টার নিক্ষেপক, ৩,২৫৫টি ট্রাক-বাহিত কাটিয়ুশা রকেট লঞ্চার ছিল; এছাড়া ছিল ৯৫,৩৮৩টি মোটর যান (যার অধিকাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত)।[১০১]

    যুদ্ধের সমাপ্তি: এপ্রিল-মে, ১৯৪৫সম্পাদনা

    ১৯৪৫ সালের ৯ই মে থেকে শুরু করে মোট ১,৪৯,৩৩,০০০ জন সোভিয়েত ও তাদের মিত্র সেনাদেরকে "জার্মানি-বিজয় পদক" দেয়া হয়।
    জার্মান সংসদ রাইখস্টাগের ওপর ওড়ানো হয় "১৫০ তম সোভিয়েত রাইফেল ডিভিশন"-এর এই পতাকা (এটিই ছিল তাদের বিখ্যাত বিজয়-নিশান)।

    সোভিয়েতদের আক্রমণের দু'টি উদ্দেশ্য ছিল। স্টালিন সন্দেহ করেছিলেন যে তার পশ্চিমা মিত্ররা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাদের দখলকৃত ভূমি সোভিয়েত ইউনিয়নকে হস্তান্তর না করতে পারে। তাই তার বাহিনীর ওপর নির্দেশ ছিল বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে পড়া এবং যতটা সম্ভব পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে তার মিত্রদের সাথে মিলিত হওয়া যায় ততটা পশ্চিমে অগ্রসর হওয়া। তবে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল বার্লিন দখল করা। এ দুটি উদ্দেশ্য একে অপরের পরিপূরক ছিল, কেননা বার্লিন অধিকার না করলে উল্লিখিত অঞ্চলসমূহ তাড়াতাড়ি দখল করা যাবে না। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল বার্লিনের কৌশলগত গুরুত্ব, এতে অ্যাডলফ হিটলার অবস্থান করছিলেন এবং জার্মানদের গোপনীয় পারমাণবিক বোমা সংক্রান্ত গবেষণাগারও ছিল এই বার্লিনে।[১০২]

    ১৬ এপ্রিল ওডার ও নাইস নদীদ্বয়ে জার্মান সম্মুখ সারির ওপর হামলার মাধ্যমে আরম্ভ হয় জার্মানি ও বার্লিন দখলের অভিযান। কয়েকদিনব্যপী তুমুল যুদ্ধের পর সোভিয়েত ১-বি.এফ. ও ১-ইউ.এফ. বাহিনী জার্মান সম্মুখ সারির প্রতিরোধে ফাটল সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় এবং এর মধ্য দিয়ে তারা জার্মানির কেন্দ্র অভিমুখে ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ এপ্রিলের মধ্যে ১-বি.এফ. এবং ১-ইউ.এফ. বাহিনীর অংশবিশেষ জার্মান রাজধানী ঘেরাও করলে শুরু হয় বার্লিনের যুদ্ধের শেষ পর্যায়। ২৫ এপ্রিল সোভিয়েত ২-বি.এফ. বাহিনী স্টেটিন নগরীর দক্ষিণে জার্মান ৩য় প্যানজার বাহিনীর সম্মুখ সারি ভেদ করতে সক্ষম হয়। এর ফলে তারা পশ্চিমে তাদের মিত্র ব্রিটিশ ২১তম যুগ্ম বাহিনীর দিকে এবং উত্তরে বাল্টিক সাগরের বন্দরনগরী স্ট্রালসুন্ড অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পায়। জার্মানির টোর্গাউ নগরীর নিকটে এলবে নদীর তীরে সোভিয়েত ৫ম রক্ষীবাহিনীর অন্তর্গত ৫৮তম রাইফেল ডিভিশনের সাথে , মার্কিন ১ম সেনাবাহিনীর ৬৯তম পদাতিক ডিভিশনের সাক্ষাৎ হয়।[১০৩][১০৪]

    বার্লিনে জার্মান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণে সোভিয়েত সেনাদের উদ্‌যাপন, ২ মে, ১৯৪৫।

    ২৯ ও ৩০ এপ্রিল, সোভিয়েত সেনাবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে বার্লিনের কেন্দ্রে পৌঁছে গেলে অ্যাডলফ হিটলার তার সঙ্গিনী ইভা ব্রাউনকে বিবাহ করেন অতঃপর তিনি সায়নাইড বিষ গ্রহণ করে ও নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। বার্লিনের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত রক্ষীবাহিনীর প্রধান হেলমাথ উইডলিং ২রা মে তারিখে সোভিয়েত বাহিনীর কাছে বার্লিন নগরী সমর্পণ করে দেন।[১০৫] সবমিলে বার্লিন অভিযানে (১৬ এপ্রিল - ২ মে) লাল ফৌজের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩,৬১,৩৬৭ জন (নিহত, আহত, নিখোঁজ ও অসুস্থ), এছাড়া ১,৯৯৭টি ট্যাংক ও কামান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ যুদ্ধে জার্মানদের ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।[১০৬]

    ১৯৪৫ সালের ৭ই মে, দিবাগত রাত ২টা ৪১ মিনিটে, ফ্রান্সের রেইম্‌সে, মিত্রবাহিনীর অভিযান পরিচালনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তরে জার্মান সেনা-প্রধান জেনারেল আলফ্রেড জোড্‌ল মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মানির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দলিলে সাক্ষর করেন। এই দলিলে উল্লেখ করা থাকে, "৮মে, ১৯৪৫ তারিখে কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় সময়ে ২৩০১ ঘটিকায় জার্মান নেতৃত্বাধীন সকল বাহিনির সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে"। মাঝরাতের ঠিক আগমুহূর্তে ফিল্ড মার্শাল উইলহেম কাইটেল, বার্লিনে সোভিয়েত জেনারের জুকভের সদর দপ্তরে এই দলিলের অনুরূপ আরেকটি দলিলে সাক্ষর করেন। এভাবেই ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয়।[১০৭]

    সোভিয়েত ইউনিয়নে ৯ই মে তারিখকে যুদ্ধ সমাপ্তির তারিখ গণ্য করা হয়, কেননা মস্কো সময়ে আত্মসমর্পণের সময়টি ৯ই মে তারিখে পড়েছিল। বর্তমানে এ তারিখটি রাশিয়ার জাতীয় দিবস- "বিজয় দিবস" হিসেবে গণ্য হয়, যাতে দুই দিন ব্যপী (৮ ও ৯ মে) ছুটি উদ্‌যাপন করা হয়, এছাড়া প্রাক্তন সোভিয়েত সদস্য কতিপয় রাষ্ট্রেও এ ছুটি উদযাপিত হয়। মস্কো বিজয় কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় ২৪ জুনে।

    জার্মান কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনীটি প্রথমে আত্মসমর্পণে অসম্মতি জানায় এবং চেকোস্লোভাকিয়ায় তারা ১১ই মে পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যায়।[১০৮]

    ডেনমার্কের বর্নহোম দ্বীপে অবস্থানরত অপর একটি জার্মান সৈন্যদলও আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানায়, অতঃপর সোভিয়েত বাহিনী দ্বীপটিতে বোমাবর্ষণ করে এবং হামলা চালিয়ে দখল করে নেয়। এর চার মাস পর দ্বীপটি ড্যানিশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

    প্রাচ্যে সোভিয়েত বাহিনীর লড়াই: আগস্ট, ১৯৪৫সম্পাদনা

    ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট শুরু হয় সোভিয়েত বাহিনীর মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ, যাতে তারা জাপান নিয়ন্ত্রিত পুতুল রাষ্ট্র মাঞ্চুকো এবং এর পার্শ্ববর্তী মেংজিগাং আক্রমণ করে; এই আক্রমণ বৃহত্তর পরিসরে কোরিয়ার উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ সাখালিন এবং কুরিল দ্বীপপুঞ্জও অন্তর্ভুক্ত হয়। খালখিন-গোলের যুদ্ধ বাদে এটিই ছিল জাপান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সোভিয়েতদের একমাত্র সামরিক অভিযান। ইউরোপ যুদ্ধের তিন মাস পর, ইয়াল্টা সম্মেলনে মিত্রদের অনুরোধে, জাপান ও সোভিয়েতের মধ্যকার নিরপেক্ষতা চুক্তি ভঙ্গ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রশান্ত-মহাসাগরীয় রণাঙ্গনে প্রবেশ করে। যদিও এই যুদ্ধ পূর্ব রণাঙ্গনের অংশ হিসেবে গণ্য হয় না তবুও পূর্ব রণাঙ্গনে অংশগ্রহণ করা সোভিয়েত জেনারেলগণই এই আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং পূর্ব রণাঙ্গনে তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান বলে এই যুদ্ধটি অনুচ্ছেদে যুক্ত হল। এই অভিযানটি অনেকাংশেই 'নিখুঁত' অভিযান বলা চলে, যাতে জার্মান "ওয়েরমাক্‌ট" ও "লুফ্‌টওয়াফ"-এর বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ চারটি বছরব্যপী পরিচালিত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হয়।[১০৯]

    যুদ্ধের ফলাফলসম্পাদনা

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বৃহত্তম ও সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী রণাঙ্গন ছিল পূর্ব রণাঙ্গন। একে মানব ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা প্রাণঘাতী সংঘাত হিসেবে গণ্য করা হয়, এ যুদ্ধে ৩ কোটিরও অধিক মানুষ নিহত হয়।[৭] জার্মান বাহিনীর মোট হতাহতের শতকরা ৮০ ভাগই সংঘটিত হয় পূর্ব রণাঙ্গনে।[১১০] ২য় বিশ্বযুদ্ধের অন্যান্য সকল রনাঙ্গনের সম্মিলিত স্থলযুদ্ধের চাইতে এই রণাঙ্গনে অধিক সংখ্যক স্থলযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ রণাঙ্গনের উভয় পক্ষেরই মানুষের প্রাণের প্রতি কোন পরোয়া না থাকায় এর যুদ্ধসমূহের প্রকৃতি ছিল নৃশংস ও ভয়াবহ। এস্থানে যুদ্ধের আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গীও এই নৃশংসতাকে তুলে ধরে, সংঘর্ষে লিপ্ত দুই পক্ষের আদর্শগত অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

    আদর্শগত যুদ্ধ ছাড়াও, নাৎসি জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃদ্বয়, যথাক্রমে অ্যাডলফ হিটলার ও জোসেফ স্টালিনের মনমানসিকতার কারণে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও এর প্রাণনাশী প্রকৃতি এক অভূতপূর্ব আকার ধারণ করে। হিটলার ও স্টালিন উভয়েই তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ করতে মানব প্রাণের তোয়াক্কা করতেন না। এমনকি তাদের নিজেদের সৈন্য ও জনগণের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করতেও তারা পিছপা হতেন না। নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে মানুষের এক একটি জনগোষ্ঠীকেও তারা ঘরছাড়া ও নির্বাসিত করে থাকতেন। এসব কারণে পূর্ব রণাঙ্গনের সামরিক ও বেসামরিক সকল নাগরিকের মধ্যেই যে এক নিষ্ঠুর প্রকৃতি পরিলক্ষিত হয়, তা অতুলনীয়। টাইম ম্যাগাজিন এর বর্ণনায়: "লোকবল, স্থায়িত্বকাল, আঞ্চলিক প্রসার এবং ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে পূর্ব রণাঙ্গনের সংঘাতের আকার ছিল নরম্যান্ডি অভিযান থেকে শুরু হওয়া পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রায় চার গুণ"।[১১১] অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপ্রধান জেনারেল জর্জ মার্শালের হিসেব অনুযায়ী, পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধে জার্মানি ব্যস্ত না থাকলে, যুক্তরাষ্ট্রকে পশ্চিম রণাঙ্গনে দ্বিগুণ সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করতে হত।[১১২]

    মার্কিন প্রেসিডেন্টের সহকারী হ্যারি হপকিন্সের স্মারকলিপি থেকে উদ্ধৃত, ওয়াশিংটন ডি.সি., ১০ আগস্ট, ১৯৪৩:

    ২য় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থান অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল, এবং অক্ষশক্তির পরাজয়ে এর ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। সিসিলিতে যখন ব্রিটিশ ও মার্কিন বাহিনী ২টি জার্মান ডিভিশনের মোকাবিলা করে, তখন রুশ বাহিনী তাদের রণাঙ্গনে প্রায় ২০০টি জার্মান ডিভিশনের মোকাবিলা করছিল। মিত্রবাহিনী যদি ইউরোপ মহাদেশে একটি দ্বিতীয় রনাঙ্গনের সৃষ্টি করে, তা হবে রুশ রনাঙ্গনের তুলনায় গৌণ; তাদের সংগ্রামই প্রাধান্য পাবে। রাশিয়া যুদ্ধে জড়িত না থাকলে ইউরোপে অক্ষশক্তিকে হারানো অসম্ভব, এবং জাতিসংঘের অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। একইভাবে যুদ্ধে-পরবর্তী ইউরোপেও রাশিয়া একটি প্রভাবশালী অবস্থানে থাকবে। জার্মানি পরাজিত হলে রাশিয়ার প্রবল প্রতাপশালী সামরিক বাহিনীর সম্মুখীন হওয়ার মত ক্ষমতা ইউরোপে আর কারো থাকবে না।[১১৩]

    ৮৭২ দিনব্যপী লেনিনগ্রাড অবরোধের সময় এর অধিবাসীগণ, এই অবরোধে প্রায় ১০ লক্ষ বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারান।

    যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহের বেসামরিক জনগোষ্ঠীসমূহ ব্যপক হারে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণনাশের শিকার হয়। জার্মান অধিকৃত অঞ্চলসমূহে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরেও বেসমারিক জনগণ নিয়মিতভাবে চলে নিষ্ঠুরতা, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ইহুদি-গণহত্যা। জার্মান ও তাদের দোসর গোষ্ঠীরা বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ব্যপক অত্যাচার-নির্যাতন চালায়, গ্রামের পর গ্রাম নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয় এবং বেসামরিক বন্দীদেরকে নিয়মিতভাবে হত্যা করা হয়। যুদ্ধের উভয় পক্ষই ব্যপকভাবে "পোড়ামাটির নীতি" অনুসরণ করে (শত্রুপক্ষের হাতে যেন না পড়ে, তাই নিজেদের জনগণের ঘরবাড়ি, ক্ষেতক্ষামার, পশু ইত্যাদি ধ্বংস করে দেয়া), তবে এ প্রক্রিয়ায় জার্মানির তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়নেরই জনগণ নিহত হয় বেশি, প্রায় ২ কোটি বেসামরিক জনগণ নিহত হয়। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জফ্রি হসকিং বলেন, "সোভিয়েত জনগণের মানবসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল এর চাইতেও বেশি: যেহেতু যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের অধিকাংশই ছিল যুবক যারা সন্তান জন্মদানের বয়সী ছিল, ১৯৩৯ সালে যুদ্ধপূর্ব অনুমানসমূহের তুলনায় তাই যুদ্ধ-পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসংখ্যা ৪.৫ থেকে ৫ কোটি কম হয়।"[১১৪]

    ১৯৪৪ সালে যখন লাল ফৌজ জার্মানি আক্রমণ করে, তখন জার্মান বেসামরিক জনগণ লাল ফৌজ সৈন্যদের প্রতিহিংসার শিকার হয়। মিত্রশক্তির মধ্যকার "ইয়াল্টা সম্মেলন" অনুষ্ঠিত হবার পরে, পূর্ব প্রুশিয়া ও সাইলেসিয়া প্রদেশের জনগণকে বিতাড়িত করে পশ্চিমে ওডার-নাইস অববাহিকার অপর পার্শ্বে যেতে বাধ্য করা হয়, যা ছিল মানব ইতিহাসের বৃহত্তম জোরপূর্বক গণ-নির্বাসনসমূহের অন্যতম।

    সোভিয়েত ইউনিয়ন ২য় বিশ্বযুদ্ধে সামরিকভাবে জয়লাভ করলেও তাদের অর্থনীতি ও অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অধিকাংশ যুদ্ধ সংঘটিত হয় জনবহুল অঞ্চলসমূহের নিকটে, এবং উভয় পক্ষের কার্যকলাপে বিশাল অঙ্কে বেসমারিক নাগরিক প্রাণ হারায় এবং সম্পদ ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়। যুদ্ধের পর জার্মানি নুরেমবার্গে সংঘটিত "আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে" জেনারেল রোমান রুডেংকো যে উদ্ধৃতি দেন, তার হিসাব মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নে অক্ষশক্তির আক্রমণে সম্পদের মোট ক্ষয়ক্ষতির অর্থমূল্য দাঁড়ায় ৬৭,৯০০ কোটি রুবল। লেনিনগ্রাড অবরোধের সময় এ নগরীর ১২ লক্ষ নাগরিক প্রাণ হারান, যুদ্ধে আক্রান্ত সকল নগরীর মধ্যে লেনিনগ্রাডেই সর্বাধিক জনগণ হতাহত হয়।[১১৫]

    মোট ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হল- ১,৭১০টি শহর ও নগরীর পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্তি, এছাড়াও ধ্বংস হয় ৭০,০০০ গ্রাম-গঞ্জ, ২,৫০৮টি গীর্জা, ৩১,৮৫০টি শিল্প-কারখানা, ৪০,০০০ মাইল রেলপথ, ৪,১০০টি রেলস্টেশন, ৪০,০০০ হাসপাতাল, ৮৪,০০০ বিদ্যালয় এবং ৪৩,০০০ লাইব্রেরি। যুদ্ধে বাস্তুহারা হয় ২কোটি ৫০লক্ষ মানুষ। ৭০ লক্ষ ঘোড়া, ১ কোটি ৭০ লক্ষ গরু, ২ কোটি শুকর, ২ কোটি ৭০ লক্ষ ভেড়া মারা পড়ে কিংবা হারানো যায়।[১১৫] বন্য জীবজন্তুও ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত বাহিনীর আক্রমণের সময় যুদ্ধক্ষেত্রসমূহ থেকে বন্য নেকড়ে ও শিয়াল পালিয়ে পশ্চিম দিকে গমন করে, এর ফলে পশ্চিমাঞ্চল সমূহে জলাতঙ্ক রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯৬৮ সালে এই জলাতঙ্ক ইংলিশ প্রণালী পর্যন্ত পৌঁছায়।[১১৬]

    নেতৃত্বসম্পাদনা

    সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং নাৎসি জার্মানি উভয়ই ছিল মতাদর্শ-ভিত্তিক রাষ্ট্র, যথাক্রমে সোভিয়েত সাম্যবাদ ও নাৎসিবাদের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রদ্বয়। এবং উভয় রাষ্ট্রেই প্রায় একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি ছিলেন এর নেতাগণ। পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধের প্রকৃতি তাই নির্ণিত হয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও তাদের মতাদর্শের দ্বারা, যা ২য় বিশ্বযুদ্ধের অপরাপর রণাঙ্গনে অতটা দেখা যায় না।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

    অ্যাডলফ হিটলারসম্পাদনা

    ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নেতৃত্ব দেন অ্যাডলফ হিটলার

    অ্যাডলফ হিটলার জার্মানদের যুদ্ধ পরিচালনাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনি তার অধিকাংশ সময় কাটাতেন তার সামরিক নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের বাংকারে (সম্ভবত এসমস্ত কেন্দ্রের অবস্থান ছিল পূর্ব প্রুশিয়ার রাস্টেনবার্গে, ইউক্রেনের ভিনিট্‌সাতে এবং বার্লিনের রাইখ্-প্রধানের বাসভবনের বাগানের নিচে)। যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়সমূহে তিনি নিয়মিত পরিস্থিতি-পর্যালোচনা সম্মেলন করতেন, যেখানে তিনি তার নিপুণ বাগ্মিতা ও যু্ক্তিতর্কের সাহায্যে তার জেনারেল ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের যেকোন মতবিরোধকে পরাভূত করতেন।

    পেশাদার সামরিক নেতৃবৃন্দের বারংবার সতর্কবাণী সত্ত্বেও ফ্রান্সের যুদ্ধে জার্মান বাহিনীর অভূতপূর্ব সাফল্যে হিটলারের আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে উঠে যায়, এবং তিনি নিজেকে একজন প্রতিভাবান সামরিক কৌশলবিদ মনে করতে থাকেন, এবং মনে করেন তার জেনারেলদের তুলনায় চলমান যুদ্ধ-পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি অধিক ওয়াকিবহাল। ১৯৪১ সালের আগস্টে জার্মান স্থলবাহিনী "ওয়েরমাক্‌ট"-এর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওয়াল্টার ফন ব্রকিচ এবং জেনারেল ফেডোর ফন বক অনুরোধ করেন মস্কো আক্রমণ করতে, কিন্তু হিটলার তাদের সকল পরামর্শ নাকট করে দেন এবং এর পরিবর্তে ইউক্রেন দখলের আদেশ দেন, যাতে এখানকার বিস্তর কৃষিভূমি, শিল্প-স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সম্পদ জার্মানদের হস্তগত হয়। কতিপয় ইতিহাসবিদ, যেমন বেভিন আলেক্সান্ডার তার "হিটলার কীভাবে জয়লাভ করতে পারতেন" শীর্ষক গ্রন্থে বলেন যে, হিটলারের এই সিদ্ধান্তে জার্মানরা যুদ্ধে জয়লাভের একটি সুবর্ণ সুযোগ হারায়।

    ১৯৪১-৪২ সালের শীতকালে হিটলারের বিশ্বাস ছিল তার জার্মান বাহিনী প্রত্যাহার না করার একগুঁয়ে সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীয় যুগ্ম বাহিনী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। পরবর্তীতে তিনি ফিল্ড মার্শাল এরহার্ড মিল্‌চকে বলেন:

    হিটলারের সাথে বৈঠকে জেনারেল ফ্রেডরিক পলাস, জেনারেল অ্যাডলফ হইসিঙ্গার এবং জেনারেল ফেডর ফন বক, জার্মান-অধিকৃত ইউক্রেনের পোলটাওয়াতে, জুন, ১৯৪২।

    আমাকে নির্মম হতে হত। আমাকে আমার নিকটস্থ জেনারেলদেরকে পর্যন্ত ফেরত পাঠাতে হয়েছিল, যেমন দু'জন জেনারেল... আমি তাঁদেরকে শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিলাম, "যত দ্রুত সম্ভব জার্মানি ফেরত যাও, কিন্তু তোমার সেনাবাহিনীকে আমার দায়িত্বে দিয়ে যাও। আর সেনাবাহিনী কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেই থাকছে।"

    মস্কোর বাইরে তার "সজারু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার" (hedgehog defence) সাফল্যের কারণে তিনি কখনো কখনো কোন অঞ্চলের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর থাকতেন, যদিও ঐ অঞ্চল ধরে রাখার কৌশলগত কোন কারণই ছিল না। এবং কোন জেনারেল তার হুকুম ব্যতীত সৈন্য প্রত্যাহার করলে তাকে তিনি বরখাস্ত করে দিতেন। প্রতিভাবান ও উদ্যোগী অফিসারদের সরিয়ে হুকুম-তামিলকারি ও গোঁড়া-নাৎসি অফিসারদের দায়িত্ব দেয়া হত। যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে স্টালিনগ্রাডের অবরোধ ও চেরকাসিতে জার্মানরা বিপর্যস্ত হয় হিটলারের সরাসরি আদেশ পালন করতে গিয়ে। অঞ্চলের কর্তৃত্ব ধরে রাখার এই অপ্রয়োজনীয় কৌশলের কারণে জার্মানদের আরেকটি ব্যর্থ পরিকল্পনার উৎপত্তি ঘটে, যার নাম দেয়া হয়, "স্বর্গ-অভিমুখে অভিযান", যা অনুসারে জার্মানরা নেহায়েৎ গুরুত্বহীন এমন অঞ্চলেও দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করে এবং এসমস্ত দুর্গ যেকোন মূল্যে প্রতিরক্ষা করে। এসমস্ত "দূর্গ-নগরীতে" অনেক জার্মান সৈন্য ডিভিশন আটকা পড়ে এবং কোন কারণ ছাড়াই লড়াই করে হতাহত হয়, কারণ হিটলার কোনপ্রকার পশ্চাদপসরণ কিংবা অভিযান বাতিলের অনুমতি দিতেন না।

    হিটলারের নেতৃত্বে অতিষ্ঠ হয়ে ১৯৪৪ সালে সামরিক বিদ্রোহের প্রচেষ্টা চালানো হয়, কিন্তু "২০ জুলাই ষড়যন্ত্রের" ব্যর্থতার ফলে হিটলার তার নিজের সেনাবাহিনী এবং এর অফিসারদের সন্দেহ করা শুরু করেন এবং বিশেষ বাহিনী এস.এস. ("শ্যুট্‌জস্টাফেল") ও নাৎসি পার্টির সদস্যদের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেন।

    হিটলারের নেতৃত্ব জার্মান সেনাবাহিনীর জন্যে বিপর্যয় বয়ে আনে, যদিও এর সৈনিক ও অফিসারদের দক্ষতা, পেশাদারিত্ব, আনুগত্য ও অধ্যবসায়ের কারণে জার্মানি শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যায়। "বাল্‌জ-এর যুদ্ধে" জার্মান জেনারেল গার্ড ফন রুনস্টেডকে দেয়া হিটলারের বার্তায় তিনি পশ্চিম অভিমুখে আক্রমণ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন, এ সম্পর্কে ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার এফ.ডব্লিউ. উইন্টারবোথাম লেখেন:

    আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই শিক্ষা পেয়েছিলাম যে, হিটলার যখন তাঁর জেনারেলদের উপদেশ অগ্রাহ্য করা শুরু করেন, তখনই তাদের সবকিছু ভন্ডুল হতে শুরু করে, এবং এই সিদ্ধান্তটিও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না।

    জোসেফ স্টালিনসম্পাদনা

    Joseph Stalin led the Soviet Union during World War II. ২য় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্ব দেস জোসেফ স্টালিন

    যুদ্ধের শুরুর ভাগে সোভিয়েত ইউনিয়নে ঘটিত বিপর্যয়সমূহের কতিপয়ের জন্যে দায়ী জোসেফ স্টালিন (যেমন, ১৯৪১ সালের কিয়েভের যুদ্ধ), তবে একই সাথে পরবর্তী যুদ্ধসমূহে লাল ফৌজের সাফল্যের জন্যে তিনি প্রশংসার দাবিদারও বটে, তার বাহিনীর এ সাফল্যের পেছনে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্রুত শিল্পায়ন, যা স্টালিন কর্তৃক ১৯৩০ এর দশকে গৃহীত আভ্যন্তরীণ কর্মসূচির কারণে সম্ভব হয়েছিল। ১৯৩০ এর দশকের শেষভাগে লাল ফৌজ থেকে স্টালিন বহু নেতাকর্মীকে বহিস্কার করেন, এবং বহু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করান, যাদের অনেককে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় ও অপরদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়।

    মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মিখাইল তুখাচেভস্কি, যিনি ট্যাংকবাহিনীর "ব্লিট্‌জক্রীগ" (ঝটিকা আক্রমণ) পদ্ধতির পক্ষপাতী ছিলেন। গ্রিগরি কুলিকের ন্যায় কতিপয় স্বার্থান্বেষীদেরকে স্টালিন পদোন্নতি দেন, যারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে তথ্য লুকোছাপা করত। এরা সেনাবাহিনীতে ট্যাংকসহ অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরোধিতা করে। অপরদিকে অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রবীণ সামরিক কর্মকর্তাদেরকে স্টালিন ছাঁটাই করে দেন, এঁদের অনেকে রুশ গৃহযুদ্ধের (১৯১৭-১৯২২) সময় থেকে সেনাবাহিনীতে কাজ করে আসছিলেন, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তাদেরকে অপসারণ করা হয়। তাদের বদলে বাহিনীতে স্থান পায় নবীন অফিসারেরা, যারা স্টালিন ও এন.কে.ভি.ডি. কর্মকর্তাদের মতে ছিল "স্টালিন-পন্থী" রাজনীতির অনুগত। এসব নতুন পদোন্নতি প্রাপ্ত কমান্ডারদের অনেকে অনভিজ্ঞ বলে প্রমাণিত হয়, যদিও এদের মধ্যে কয়েকজন যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে সাফল্যের দেখা পায়। এতকিছুর পরও সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর বৃহত্তম ট্যাংক বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়।

    ১৯১৮ সালে সর্বপ্রথম লাল ফৌজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর, রাজনৈতিক আস্থাহীনতার কারণে সামরিক বাহিনীতে "দ্বৈত শাসন" দেখা দেয়, প্রতি কমান্ডারের সাথে নিযুক্ত করা হয় একজন "রাজনৈতিক কমিসার", এই কমিসার থাকতেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য। সেনাবাহিনীর বড় পরিসরের যেকোন বিভাগে একটি সামরিক পরিষদ থাকত, যার সদস্য থাকতেন কমান্ডার, কমিসার এবং প্রধান সামরিক কর্মকর্তা। কমিসারগণের দায়িত্ব থাকত পার্টির প্রতি সামরিক বাহিনীর আনুগত্য নিশ্চিত করা।

    সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চল, বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ, বেসারাবিয়া ও উত্তর বুকোভিনা দখলের পর স্টালিন আদেশ দেন এই নতুন অধিকৃত অঞ্চলসমূহের প্রতিটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্যে; তার এই আদেশ পালন করতে গিয়ে সোভিয়েত বাহিনীকে বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে হয়, ফলে তারা মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন দূরবর্তী ঘাঁটিতে অবস্থান নেয় এবং শত্রুর আক্রমণের মোকাবিলায় নাজুক অবস্থানে থাকে। ১৯৪১ সালের বসন্তকালে যখন পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে ওঠে, এসময় হিটলার যেন আক্রমণ করার কোন অজুহাত খুঁজে না পান স্টালিন যতদূরসম্ভব সে প্রচেষ্টা করেন; স্টালিন তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া থেকে বিরত রাখেন, এমনকি যখন জার্মান বাহিনী সোভিয়েত সীমান্তের নিকটে অবস্থান নেয় এবং জার্মান গোয়েন্দা বিমান সোভিয়েত স্থাপনার ওপর দিয়ে উড্ডয়ন করতে থাকে, তখনও তিনি তার সৈন্যদের সতর্ক করেননি। স্টালিনের এরূপ যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোই ছিল জার্মান-সোভিয়েত যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সোভিয়েত বিমান বাহিনীর বিপর্যয়ের কারণ, যারা বিমান ঘাঁটিসমূহে সারিবদ্ধভাবে সজ্জিত ছিল।

    ১৯৪২ সালের শরত্কালে, তুমুল যুদ্ধের সময়, স্টালিন তার সেনাবাহিনীতে বিপুল পরিবর্তন আনেন: সেনাবাহিনী থেকে কমিসারগণকে প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৪৫ সালের ১৫ জানুয়ারিতে "আদেশ নং ২৫" জারি করা হয়, যাতে সকল শ্রেণীর সৈন্যদের কাঁধের ব্যাজ পরিধান করতে আদেশ দেয়া হয়; এই আদেশের প্রতীকী গুরুত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য, কেননা ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের সময় এসকল কাঁধের ব্যাজ (যা সৈনিক ও অফিসারগণের পদ চিহ্নিত করে) নিষিদ্ধ করা হয়, কেননা একে "জার-বাদী শাসনের" প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৪১ সালের শরত্কাল থেকে, যেসকল সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা ও কৌশলের পরিচয় দেয় তাদেরকে "গার্ড" উপাধি প্রদান করা হয়।[১১৭]

    সেনাবাহিনীর এসকল পরিবর্তনকে কঠোর শাসনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা হয়: ১৯৪২ সালের ২৮ জুলাই "আদেশ নং ২২৭" জারি করা হয়, যাতে বলা হয়, যেসকল কমান্ডার আদেশ ছাড়াই পিছু হটবে তাদেরকে সামরিক আদালত "কোর্ট-মার্শালে" শাস্তি প্রদান করা হবে। সামরিক ও "পলিট্রুক" সদস্যরা আদেশ অমান্য করলে তাদেরকে "দণ্ডিত ব্যাটালিয়ন" সমূহে এবং "দণ্ডিত কোম্পানি" সমূহে বদলি করে দেয়া হত, এসব দণ্ডিত ব্যাটালিয়ন ও কোম্পানিকে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী দায়িত্বে পাঠানো হত, যেমন নাৎসি মাইনক্ষেত্রসমূহের ওপর দিয়ে হেঁটে মাইন পরিষ্কার করা।[১১৮] যুদ্ধক্ষেত্রে ভীত ও পলায়নরত "কাপুরুষদের" আটক ও হত্যা করার আদেশ দেয়া হয়, যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখ সারির পেছনে বাধাদানকারী সৈন্যদল অবস্থান করানো হয়, যারা যুদ্ধের প্রথম তিন মাসে ১,০০০ জন দণ্ডিত সৈন্যকে হত্যা করে এবং ২৪,৯৯৩ জনকে "দণ্ডিত ব্যাটালিয়নে" বদলি করে দেয়।[১১৯] ১৯৪২ সালের অক্টোবরের মধ্যে এসব বাধাদানকারী সৈন্যদল অবস্থান করানোর প্রথা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে, ১৯৪৪ সালের মধ্যে এদের আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়।[১২০][১২১]

    যখন এ বিষয় স্পষ্ট হয়ে আসল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছে, তখন এরূপ প্রচারের নির্দেশ দেয়া হয় যে, স্টালিনের নিজের নেতৃত্ববলে সোভিয়েত বাহিনীর জয় সুনিশ্চিত হয়েছে; বিজয়ী জেনারেলদেরকে তিনি প্রচারের আড়াল করে রাখেন, যাতে তিনি ছাড়া অন্য কেউ রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা লাভ করতে না পারে। যুদ্ধ শেষে সোভিয়েতরা পুনরায় লাল ফৌজে গণহারে ছাঁটাই করে (যদিও ১৯৩০ এর ন্যায় বিপুলহারে নয়), এবং বহু সফল সেনাধিনায়ককে নিম্নপদে ও অগুরুত্বপূর্ণ পদে অপসারণ করা হয়, যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন জেনারেল জুকভ, জেনারেল ম্যালিনোভস্কি ও জেনারেল কোনিয়েভ।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

    অধিকৃত অঞ্চলসমূহে নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞসম্পাদনা

    জার্মান অধিকৃত লিথুয়ানিয়ার কাউনাস অঞ্চলে ইহুদি গণহত্যা, যার নাম দেয়া হয় "কাউনাস পগ্রম", জুন, ১৯৪১।

    ১৯৪১ সালে জার্মান বাহিনী কর্তৃক বিস্তর ভূখণ্ড দখলের পর এসমস্ত অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখা ও প্রশাসন-কাজ পরিচালনা করার প্রয়োজন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিকাংশ জনগণের দৃষ্টিতে নাৎসি আক্রমণ ছিল কোনপ্রকার উস্কানি ছাড়াই এক অন্যায় আগ্রাসন। তবে এবিষয় উল্লেখযোগ্য যে, সোভিয়েত সমাজের সকলেই জার্মানদের প্রতি এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে না। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়াসহ অন্য কিছু অঞ্চলে (যারা ১৯৪০ সালে সোভিয়েত বাহিনী কর্তৃক দখল হয়েছিল) জনগণের উল্লেখযোগ্য অংশ "ওয়েরমাক্‌ট" বাহিনীকে তুলনামূলক সহ্য করে থাকে।

    সোভিয়েত ইউনিয়নে সদ্য পুনর্যোগদানকারী পশ্চিম ইউক্রেনের অধিবাসীদের জন্যে এই বিষয়টি অতীব সত্য। এসকল অঞ্চলে পোলিশ-বিরোধী ও সোভিয়েত-বিরোধী "ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী গুপ্তদল" একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়, এই দলটি জার্মান সেনাবাহিনীর সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ডের অধিকাংশ জনগণই নাৎসিদেরকে আগ্রাসী শত্রুরূপে দেখত। ইউক্রেনীয় ও কোসাক জনগোষ্ঠীর সদ্যপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনসমূহকে হিটলার সন্দেহের চোখে দেখেন; বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহসহ কতিপয় রাষ্ট্রে এরূপ আন্দোলনকারীদের অক্ষশক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে অন্যদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এসমস্ত জার্মান-অধিকৃত অঞ্চলের কোনটিই কোনপ্রকার স্বাধীন শাসনক্ষমতা পায়নি।

    বরং নাৎসিবাদের সমর্থকরা পূর্ব ইউরোপকে দেখত জার্মানদের ভবিষ্যৎ স্থায়ী বসতি রূপে এবং এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের গণহত্যা, নির্বাসন কিংবা জার্মানদের দাসত্বে আবদ্ধ করার পরিকল্পনা ছিল নাৎসিবাদীদের। সোভিয়েত বেসামরিক জনতা, নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের প্রতি নিষ্ঠুর নির্মমতা প্রদর্শন করা হয়, বেসামরিক বাসস্থান ও নগরীর ওপর নিয়মিত বোমা হামলা চালানো হয়, সোভিয়েত গ্রামগঞ্জসমূহে নাৎসিরা লুঠতরাজ চালায়, এবং সোভিয়েত নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়। এসমস্ত কারণেই সোভিয়েত জনগণ নাৎসি বাহিনীর প্রতিরোধে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। নাৎসিদের আসল পরিকল্পনা যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে দখল ও দাসত্বে আবদ্ধ করা, তা বুঝতে সোভিয়েতগণের দেরি হয়নি।

    একটি বিখ্যাত আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে একজন ইহুদি নারীকে হত্যা করতে রাইফেল উদ্যত করছে একজন নাৎসি সৈন্য, উক্ত নারী তাঁর শিশুকে রক্ষা করতে নিজের দেহের আড়ালে ঢেকে রাখছেন, ইউক্রেনের ইভানগোরড গ্রাম, ১৯৪২ সাল।

    সম্মুখ সমরের নিকটস্থ অঞ্চলগুলোর ব্যবস্থাপনা করত এর নিয়ন্ত্রণকারী সামরিক বাহিনী। অন্যান্য অঞ্চল, যেমন- বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহে স্থাপিত হয় "রাইখ-কমিসারিয়াত"। উক্ত কমিসারিয়াতদের দায়িত্ব ছিল সর্বাধিক পরিমাণ সম্পদ যেন লুঠ করা হয়। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইউক্রেনের কমিসারিয়াত নিযুক্ত হন নাৎসি পার্টির এরিক কখ। তার উদ্বোধনী বক্তৃতাতেই জার্মানদের নীতি পরিষ্কারভাবে বোধগম্য হয়: "আমি পরিচিত একজন ভয়াবহ কুকুর হিসেবে... আমাদের কাজ হল ইউক্রেন থেকে যতটা সম্ভব ধন-সম্পদ আহরণ করা... আমি আশা করছি স্থানীয়দের প্রতি যতটা সম্ভব নির্মমতা প্রদর্শন করা যায়, তোমরা ততটাই করবে"।

    অধিকৃত অঞ্চলসমূহ দখল করার সাথে সাথেই এর ইহুদি জনগোষ্ঠীর ওপর শুরু হয় নিপীড়ন, এ কাজে নিযুক্ত করা হয় বিশেষ কর্মীবাহিনী "আইনসাট্‌জ গ্রুপেন", যাদের কাজ ছিল ইহুদিদের খুঁজে খুঁজে আটক করা এবং গুলি করে হত্যা করা।[১২২]

    ইহুদি ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা ছিল জার্মান অধিকৃত অঞ্চলে হত্যাকাণ্ডের একটি অংশ মাত্র। লক্ষ লক্ষ সোভিয়েত জনগণ নাৎসিদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়, এবং আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুবরণ করে, যখন জার্মানরা তাদের সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্যশস্য লুঠ করে নিয়ে যায়, এমনকি তাদের ঘোড়াদের জন্য গবাদি পশুর খাবারও লুঠ করে নেয়া হয়। ১৯৪৩-৪৪ সালে জার্মানরা যখন ইউক্রেন ও বেলারুশ থেকে পলায়ন করে, পলায়নের পূর্বে তারা "পোড়ামাটির নীতি" অবলম্বন করে, গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দর পুড়িয়ে দেয়া হয়, রাস্তা-ঘাট-রেলপথ ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয় এবং এ অঞ্চলের জনগণ শীতে-অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।[১২৩] যে নগরীসমূহে যুদ্ধ সংঘটিত হত, এদের নাগরিকেরা প্রায়ই গোলাগুলি মাঝখানে পতিত হত। সোভিয়েত ইউনিয়নে মোট বেসামরিক নিহতের সংখ্যা ধারণা করা হয় ৭০ লক্ষ ("এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা" অনুযায়ী) থেকে ১ কোটি ৭০ লক্ষ (রিচার্ড ওভেরির মতে)।

    ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে নাৎসি বাহিনী কর্তৃক ফাঁসিপ্রাপ্ত সোভিয়েত পার্টির সদস্যগণ।

    নাৎসি মতাদর্শ এবং সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী ও স্থানীয় জনগণের ওপর তাদের অত্যাচার নির্যাতনের ফলে পার্টির সদস্যরাও উদ্বুদ্ধ হন সম্মুখ সমরে অংশ নেয়ার জন্যে; এমনকি কমিউনিস্ট-বিরোধী ও রুশ ব্যতীত অন্যান্য জাতীয় নাগরিকগণও সোভিয়েত বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে থাকেন, এতে জার্মান-পন্থী কোন বাহিনী গড়তে ব্যপক বেগ পেতে হয়। এসমস্ত কারণ "ওয়েরমাক্‌ট" এর পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে।

    ভাদিম এরলিকম্যান সোভিয়েতদের হতাহতের হিসাব দেন: ২ কোটি ৬৫ লক্ষ যুদ্ধ-সংক্রান্ত মৃত্যু। সামরিক হতাহত ১ কোটি ৬ লক্ষ, যার মধ্যে ৬০ লক্ষ নিহত অথবা নিখোঁজ, ৩৬ লক্ষ যুদ্ধবন্দী শিবিরে নিহত এবং ৪ লক্ষ মিলিশিয়া ও সোভিয়েত পার্টি সদস্য নিহত। বেসামরিক নাগরিক নিহত ১ কোটি ৫৯ লক্ষ, যার মধ্যে সামরিক কর্মকাণ্ডে নিহত ১৫ লক্ষ; নাৎসি গণহত্যা ও নিপীড়নে নিহত ৭১ লক্ষ; ১৮ লক্ষ জার্মানিতে জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োজিত; এবং ৫৫ লক্ষ অনাহারে ও রোগব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত। ১৯৪৬-৪৭ সালে যুদ্ধপরবর্তী অনাহারে মৃত আরো ১০ লক্ষ নাগরিককে এ গণনায় ধরা হয়নি। এ গণনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন অধিকৃত সকল অঞ্চলের জন্যে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ১৯৩৯-৪০ সালে দখলকৃত অঞ্চলসমূহ।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

    অধিকৃত অঞ্চলে বাস্তুহারা রুশ শিশুরা (আনুমানিক ১৯৪২ সাল)।

    বেলারুশের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ নিহত হয়, এর বুদ্ধিজীবী নাগরিকগণ প্রায় সকলেই নিহত হন। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে জার্মানি বর্তমান বেলারুশের সমস্ত অঞ্চল দখল করে নেয়। এদেশে নাৎসিরা এক বর্বরোচিত শাসন কায়েম করে, ৩,৮০,০০০ জন যুবককে দাসবৃত্তির কাজে লাগানো হয়, এবং আরো লক্ষ লক্ষ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়।[১২৪] "খাটিন"-এর ন্যায় প্রায় ৬০০টি গ্রাম-গঞ্জ জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং এর সকল অধিবাসীকে হত্যা করা হয়।[১২৫] ২০৯টিরও বেশি শহর ও নগরী জ্বালিয়ে দেয়া হয়, (বেলারুশের মোট ২৭০টি নগরের মধ্যে) এবং ৯,০০০টি গ্রাম ধ্বংস করা হয়। হিমলার এক পরিকল্পনা উত্থাপন করে যাতে বেলারুশের তিন-চতুর্থাংশ জনগণকে "নির্মূলীকরণের" (গণহত্যা) জন্য চিহ্নিত করা হয় এবং এক-চতুর্থাংশ জনগণ, যারা "পরিষ্কার" জাতের (নীল চোখ, হালকা রঙের চুল) জনগণকে জার্মানদের দাস হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার পরিকল্পনা করা হয়।

    কোন কোন বর্ণনা মতে যুদ্ধে নিহত বেলারুশদের সংখ্যা গণনা করা হয় ৩৬ লক্ষ ৫০ হাজার জন, যা পূর্ববর্তী হিসাব ২২ লক্ষকে ছাড়িয়ে যায়। এ হিসেবে এক-চতুর্থাংশ নয় বরং বেলারুশের যুদ্ধ-পূর্ব জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগই মৃত্যুবরণ করেন (বর্তমান বেলারুশ সীমান্তের ভেতর)।[১২৬]

    জার্মান-অধিকৃত পোল্যান্ডের ডেবলিনে জার্মান বাহিনীর হত্যার শিকার সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীগণের গণকবর।

    যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীদের ৬০ শতাংশ নিহত হন। যুদ্ধ শেষে বহুসংখ্যক সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী, জোরপূর্বক নিযুক্ত শ্রমিক এবং নাৎসিদের দোসরদের (যারা মিত্রবাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক পুনর্বাসিত হয়) সোভিয়েত এন.কে.ভি.ডি. বাহিনীর বিশেষ "নির্বাচন" শিবিরের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ১৯৪৬ সালের মধ্যে বেসামরিক নাগরিকদের ৮০ শতাংশ ও যুদ্ধবন্দীদের ২০ শতাংশকে মুক্তি দেয়া হয়, অন্যদের আবার সেনাবাহিনীতে যুক্ত করানো হয় এবং শ্রমিক ব্যাটালিয়নে নিযুক্ত করা হয়। বেসামরিক নাগরিকদের ২ শতাংশ ও যুদ্ধবন্দীদের ১৪ শতাংশকে "গুলাগে" (কয়েদ শিবির) পাঠানো হয়।[১২৭][১২৮]

    পোলিশ সরকারের ১৯৪৭ সালের রিপোর্টে যুদ্ধকালীন হতাহতের সংখ্যা দেখানো হয় ৬০,২৮,০০০ জন নিহত, মোট পোলিশ ও ইহুদি জনগণ ২,৭০,০৭,০০০-এর মধ্যে; এই রিপোর্টে স্থানীয় ইউক্রেনীয় ও বেলারুশ জনগোষ্ঠীর নিহতদের ধরা হয়নি।

    যদিও ১৯২৯ সালের জেনেভা কনভেনশনে সোভিয়েত ইউনিয়ন সাক্ষর করেনি, তবুও, তারা নিজেদেরকে ১৮৯৯ ও ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশনের শর্তাধীন বলে গণ্য করেছিল।[১২৯] ১৯৪১ সালে জার্মানদের আক্রমণের পর, জার্মানদের নিকট একটি বার্তা পাঠানো হয় যাতে উভয় পক্ষকে "হেগ কনভেনশন" মেনে চলার প্রস্তাব দেয়া হয়। রাইখ কর্তৃপক্ষ থেকে এই বার্তার কোনো জবাব দেয়া হয়নি।[১৩০]

    সোভিয়েতদের নিপীড়নও পূর্ব রণাঙ্গনের নিহতের সংখ্যায় অবদান রাখে। সোভিয়েত অধিকৃত পোল্যান্ড, বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ ও বেসারাবিয়াতে গণহারে অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড চলে। জার্মান আক্রমণের পর এন.কে.ভি.ডি. বাহিনী পশ্চিম বেলারুশ ও পশ্চিম ইউক্রেনে অবস্থিত কারাগারসমূহে বন্দীদের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়, এবং জীবিতদেরকে হত্যার জন্যে ঢালাওভাবে বের করে নিয়ে আসা হয়।[১৩১]

    যুদ্ধকালীন শৈল্পিক উৎপাদনসম্পাদনা

    সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়ের অন্যতম প্রধান একটি কারণ হল, ব্যপক জনবল ও ভূখণ্ড হারানো সত্ত্বেও শিল্প উৎপাদন ক্ষমতায় তারা জার্মানিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৩০-এর দশকে স্টালিনের "৫ বছর-ব্যপী পরিকল্পনার" বদৌলতে ইউরাল অঞ্চল ও মধ্য এশিয়ায় ব্যপক হারে শিল্পায়ন সংঘটিত হয়। ১৯৪১ সালে হাজার হাজার রেলগাড়িতে করে ইউক্রেন ও বেলারুশের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাসমূহ থেকে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাদি ও শ্রমিকদেরকে নিরাপদ এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। ইউরাল পর্বতমালার পূর্বে এসব শিল্প-স্থাপনা পুনর্নির্মিত হলে জার্মান বোমা হামলার আশঙ্কা ছাড়াই শিল্পোত্পাদন পুনরায় আরম্ভ হয়।

    ১৯৪৩ সালের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার জনবল হারাতে শুরু করলে সোভিয়েত আক্রমণসমূহে তারা সৈন্যদের প্রাণ উৎসর্গের বদলে উন্নত সরঞ্জাম ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বেসামরিক নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানকে উৎসর্গ করে সামরিক সরঞ্জাম ও সামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয় - মূলতঃ "সামগ্রিক যুদ্ধ" (total war) নীতি অনুসরণের মাধ্যমে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে প্রাপ্ত "লেন্ড-লীজ" সহায়তাও তাদের শিল্পোত্পাদনে ভূমিকা রাখে। অপরদিকে জার্মানরা নির্ভর করতে থাকে তাদের অধিকৃত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী ও সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীদের থেকে আদায়কৃত জোরপূর্বক শ্রমের ওপর। মার্কিন রপ্তানী ও প্রযুক্তিগত কৌশল সোভিয়েতদের এমন সব পণ্য উৎপাদনের উপায় করে দেয় যা তারা অন্যথা উৎপাদনে অক্ষম ছিল। উদাহরণস্বরূপ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ৭০ থেকে ৭৪ অকটেন নম্বরযুক্ত জ্বালানী তৈরি করতে পারলেও ৯০+ অকটেন নম্বরযু্ক্ত জ্বালানী চাহিদার কেবল ৪ শতাংশই তারা উৎপাদন করতে পারত, ১৯৩৯ সালের পর থেকে সকল উড়োজাহাজেই এসব উচ্চমানের ৯০+ অকটেন নম্বরযুক্ত জ্বালানী প্রয়োজন হত। এই উচ্চমানের জ্বালানীর চাহিদা মেটাতে সোভিয়েতরা তাই যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল ছিল, ৯০+ অকটেনসমৃদ্ধ জ্বালানী ও টেট্রাইথাইল লেড, উভয়েই তারা আমদানি করত।[১৩২]

    জার্মানির নিকট সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে অধিক পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল, এবং তার উৎপাদন ক্ষমতা তেল ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে সোভিয়েতদের তুলনায় অত্যধিক ছিল। তাদের কয়লা উৎপাদন সোভিয়েতদের ৫ গুণেরও বেশি ছিল, এছাড়া লোহা উৎপাদনে তারা সোভিয়েতদের তিনগুণের অধিক, ইস্পাত উৎপাদনে সোভিয়েতদের তিনগুণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সোভিয়েতদের দ্বিগুণ ছিল এবং শুধুমাত্র তেল উৎপাদনে সোভিয়েতদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল, অর্থ্যাৎ পিছিয়ে ছিল।[১৩৩]

    ১৯৪০-১৯৪৪ সালের মধ্যে জার্মানদের বিস্ফোরক উৎপাদন ছিল ১৫.৯৫ লক্ষ টন এবং বারুদ উৎপাদন ছিল ৮,২৯,৯৭০ টন। সকল রণাঙ্গন মিলে বিস্ফোরকের খরচ ছিল ১৪.৯৩ লক্ষ টন এবং বারুদের খরচ ছিল ৬,২৬,৮৮৭ টন।[১৩৪] ১৯৪১-১৯৪৫ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন উৎপাদন করেছিল মাত্র ৫,০৫,০০০ টন বিস্ফোরক এবং ১,০৫,০০০ টন তারা "লেন্ড-লিজ" সহায়তা হিসেবে পেয়েছিল।[৫৬] সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় জার্মানরা ৩.১৬ গুণ বেশি বিস্ফোরক উৎপাদন করেছিল।

    সোভিয়েতরা জার্মানির তুলনায় অধিক সংখ্যক ট্যাংক ও অন্যান্য যুদ্ধ-যান নির্মাণ করেছিল। (১৯৪৩ সালে, সোভিয়েত নির্মিত ট্যাংক ও চলমান কামানের সংখ্যা ছিল ২৪,০৮৯টি, অপরদিকে জার্মানরা নির্মাণ করে ১৯,৮০০টি)। সোভিয়েতরা তাদের পূর্বের নকশাসমূহকে উন্নত করে এবং নির্মাণ কৌশলকে সহজীকরণ করে যাতে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়। এছাড়া উৎপাদন কঠিন- এমন দ্রব্যসামগ্রী তারা "লেন্ড-লিজ" অনুদান থেকে প্রাপ্ত হয়, যেমন- বিমান-জ্বালানী, কারখানার যন্ত্রাংশ, ট্রাক এবং বিস্ফোরক, যার ফলে তারা অল্প কিছু দ্রব্যের উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে পারে। অপরদিকে জার্মানি সকল প্রকার বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ায় এবং দুটি রণাঙ্গনে একযোগে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় তাদের উৎপাদন ক্ষমতা দিনে দিনে হ্রাস পেতে থাকে। এছাড়া তাদের এমন সব দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে হয়, যা সোভিয়েতদের উৎপাদন করতে হয় না (যেমন- ট্রাক), অথবা এমন দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদন করতে হয়, যা সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায় না, (যেমন- জাহাজ)। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণেই জার্মানদের মোট যুদ্ধ-সংক্রান্ত খরচের ১০-১৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়; অপরদিকে ট্যাংকসহ অন্যান্য যুদ্ধযান নির্মাণে খরচ হয় মাত্র ৫-৮ শতাংশ।[১৩৫]

    জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধকালীন কাঁচামাল উৎপাদনের সারাংশ[১৩৬]
    সালকয়লা
    (লক্ষ টন, জার্মানির ক্ষেত্রে লিগনাইট ও বিটুমিনাস টাইপ অন্তর্ভুক্ত)
    ইস্পাত
    (লক্ষ টন)
    অ্যালুমিনিয়াম
    (হাজার টন)
    তেল
    (লক্ষ টন)
    জার্মানসোভিয়েতজার্মানসোভিয়েতজার্মানসোভিয়েতজার্মানসোভিয়েতইতালীয়হাঙ্গেরীয়রোমানীয়জাপানী
    ১৯৪১৪৮৩৪১৫১৪৩১৮১৭৯২৩৩.৬৫৭৩৩০১.২৫৫
    ১৯৪২৫১৩১৭৫৫৩২১৮১২৬৪.০৫১.৭৬৬২২০০.১৫৭১৮
    ১৯৪৩৫২১৪৯৩১৩৪৬৮৫২৫০.০৬২.৩৭৬১৮০০.১৫৩২৩
    ১৯৪৪৫০৯৮১২১৫২৮৫১০৯২৪৫.৩৮২.৭৫৫১৮২১০৩৫১০
    ১৯৪৫[১৩৭]১৪৯৩১২৩৮৬.৩১৩১৯৪১০
    অক্ষশক্তি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধকালীন ট্যাংক ও চলমান কামান উৎপাদনের সারমর্ম[১৩৬]
    সালট্যাংক ও চলমান কামান
    সোভিয়েতজার্মানইতালীয়হাঙ্গেরীয়রোমানীয়জাপানী
    ১৯৪১৬,৫৯০৫,২০০[১৩৮]৫৯৫৫৯৫
    ১৯৪২২৪,৪৪৬৯,৩০০[১৩৮]১,২৫২৫০০৫৫৭
    ১৯৪৩২৪,০৮৯১৯,৮০০৩৩৬১০৫৫৫৮
    ১৯৪৪২৮,৯৬৩২৭,৩০০৩৫৩
    ১৯৪৫[১৩৭]১৫,৪০০১৩৭
    অক্ষশক্তি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধকালীন বিমান উৎপাদনের সারমর্ম[১৩৬]
    সালবিমান সংখ্যা
    সোভিয়েতজার্মানইতালীয়হাঙ্গেরীয়রোমানীয়জাপানী
    ১৯৪১১৫,৭৩৫১১,৭৭৬৩,৫০৩১,০০০৫,০৮৮
    ১৯৪২২৫,৪৩৬১৫,৫৫৬২,৮১৮৮,৮৬১
    ১৯৪৩৩৪,৮৪৫২৫,৫২৭৯৬৭২৬৭১৬,৬৯৩
    ১৯৪৪৪০,২৪৬৩৯,৮০৭৭৭৩২৮,১৮০
    1945[১৩৭]২০,০৫২৭,৫৪৪৮,২৬৩
    জার্মান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক সংখ্যা (হাতে কাজ করা শ্রমিকগণও অন্তর্ভুক্ত), এবং বিদেশী, স্বেচ্ছাসেবী, জোরপূর্বক ও যুদ্ধবন্দী শ্রমিক সংখ্যা[১৩৯]
    সালশিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকবিদেশী শ্রমিকমোট শ্রমিক
    সোভিয়েতজার্মানসোভিয়েতজার্মানসোভিয়েত মোটজার্মান মোট
    ১৯৪১১,১০,০০,০০০১,২৯,০০,০০০৩৫,০০,০০০১,১০,০০,০০০১,৬৪,০০,০০০
    ১৯৪২৭২,০০,০০০১,১৬,০০,০০০৫০,০০০৪৬,০০,০০০৭২,৫০,০০০১,৬২,০০,০০০
    ১৯৪৩৭৫,০০,০০০১,১১,০০,০০০২,০০,০০০৫৭,০০,০০০৭৭,০০,০০০১,৬৮,০০,০০০
    ১৯৪৪৮২,০০,০০০১,০৪,০০,০০০৮,০০,০০০৭৬,০০,০০০৯০,০০,০০০১,৮০,০০,০০০
    ১৯৪৫[১৩৭]৯৫,০০,০০০২৯,০০,০০০১,২৪,০০,০০০

    সোভিয়েত যুদ্ধকালীন উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের "লেন্ড-লিজ" কর্মসূচি। সমগ্র যুদ্ধের স্থায়িত্বকালে যুক্তরাষ্ট্র "লেন্ড-লিজ" কর্মসূচির আওতায় ১১০০ কোটি মার্কিন ডলার সমমূল্যের রসদ সোভিয়েত ইউনিয়নকে সরবরাহ করে থাকে। এর অন্তর্ভুক্ত হল ৪,০০,০০০ ট্রাক, ১২,০০০ যুদ্ধযান (যার মধ্যে রয়েছে ৭,০০০ ট্যাংক), ১১,৪০০ উড়োজাহাজ এবং ১৭.৫ লক্ষ খাদ্যদ্রব্য।[১৪০] এবং ব্রিটিশরা সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেয় ৩,০০০ "হারিকেন" জঙ্গী বিমান এবং ৪,০০০ অন্যান্য বিমান। ব্রিটেন ও কানাডা মিলে সরবরাহ করে ৫,০০০ ট্যাংক। ব্রিটিশদের সরবরাহকৃত মোট রসদ ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ টন।[১৪১] অপরদিকে জার্মানি তাদের দখলকৃত অঞ্চলের সম্পদ ও উৎপাদন ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়; এসব উৎপাদন ক্ষমতা উপর্যুক্ত সারণিতে গণ্য করা হয়নি, যেমন- ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ইত্যাদি রাষ্ট্রের উৎপাদন।

    স্টালিনগ্রাডে জার্মানদের পরাজয়ের পর, তাদের অর্থনীতি পুরোপুরিভাবে যুদ্ধ-অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়, যা বার্লিন স্পোর্টপালাস্ট প্রাঙ্গনে নাৎসি প্রচার-মন্ত্রী জোসেফ গোয়েব্‌লসের বক্তৃতা থেকে স্পষ্ট। রাইখের রণসজ্জা বিষয়ক মন্ত্রী আলবার্ট স্পিয়ারের ব্যবস্থাপনাতে, জার্মানদের যুদ্ধকালীন উৎপাদন যুদ্ধের শেষ বছরগুলোতে ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছিল, এমনকি মিত্রবাহিনীর বিমান-বোমা হামলা সত্ত্বেও।

    হতাহতের সংখ্যাসম্পাদনা

    সোভিয়েতগণ তাদের মৃতদের সমাহিত করছেন, জুলাই, ১৯৪৪।
    ২য় বিশ্বযুদ্ধে সামরিক মৃত্যু, রণাঙ্গন ও সাল অনুসারে।

    এ রণাঙ্গনে মানব ইতিহাসের সবচাইতে বড় স্থলযুদ্ধ ও সংঘাতসমূহ সংঘটিত হয়। এবং ইউরোপীয় রনাঙ্গনসমূহের মধ্যে এটিই ছিল সর্বাধিক প্রাণঘাতী ও রক্তক্ষয়ী রণাঙ্গন, যাতে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর প্রায় ১ কোটি সদস্যের প্রাণ যায় (যদিও ভিন্ন হিসাব মতে প্রাচ্য রণাঙ্গনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনুরূপ হতে পারে)।[১৪২][১৪৩][১৪৪] অক্ষশক্তির সামরিক মৃত্যুসংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষ, যার মধ্যে প্রায় ৪০ লক্ষ ছিল জার্মান সেনা।[১৪৫][১৪৬]

    এসকল গণনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রায় ২০ লক্ষ জার্মান সেনা যাদেরকে যুদ্ধের পর খুঁজে পাওয়া যায়নি। রুডিগার ওভারম্যান্স বলেন যে, এটি প্রমাণ করা যায় যে, এসব নিখোঁজের অর্ধেক যুদ্ধে নিহত হয়েছে এবং বাকি অর্ধেক সোভিয়েতদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছে।[১৪৭] জার্মান সেনা কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক হিসাব মতে "হীয়ার" সেনাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নিহত/নিখোঁজ/যুদ্ধবন্দী হয়েছে, যারা পূর্ব রণাঙ্গনে ১৯৩২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৫ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত যুদ্ধরত ছিল (যুদ্ধের সমাপ্তি থেকে ৪ মাস ও ১ সপ্তাহ আগ পর্যন্ত), এ হিসেবে নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।[১৪৮]

    বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ধারণা করা হয় ১.৪০ কোটি থেকে ১.৭০ কোটির মধ্যে। ১৯৩৯-পূর্ব সোভিয়েত সীমান্তে বসবাসরত বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে ১ কোটি ১৪ লক্ষ মানুষ নিহত হয় এবং দখলকৃত অঞ্চলসমূহে আরো ৩৫ লক্ষ নিহত হয়।[১৪৯] নাৎসি বাহিনী ১০ থেকে ২০ লক্ষ সোভিয়েত ইহুদিকে হত্যা করে (দখলকৃত অঞ্চলসহ) তাদের ইহুদি গণহত্যার অংশ হিসেবে।[১৫০] সোভিয়েত ও রুশ ঐতিহাসিক গবেষণায় প্রায়ই এই কথাটির উল্লেখ দেখা যায় "গণনার বাইরের হতাহত"। সোভিয়েত সরকারের প্রতিরক্ষা আদেশ নং ০২৩, (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪)-এর মতে, এই অগণিত হতাহতের মধ্যে রয়েছে নিহত, নিখোঁজ, যুদ্ধের ক্ষত থেকে পরবর্তীতে মৃত, রোগবালাই ও শৈত্যের কারণে মৃত এবং যুদ্ধবন্দী।

    এই বিশাল অঙ্কে মৃতের কয়েকটি প্রধান কারণ হল- যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ব্যপক জুলুম, অনাহার, সোভিয়েত অঞ্চলসমূহে চিকিৎসা-সামগ্রীর অভাব এবং বেসামরিক নাগরিকগণের ওপর জুলুম-হত্যা যার অধিকাংশ দায় জার্মান বাহিনীর। কয়েকটি যুদ্ধে "পোড়ামাটির নীতি" গৃহীত হয়, যাতে কৃষিভূমি, অবকাঠামো, শহর-নগর-বন্দর সমস্তকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়, এবং বিস্তর জনগোষ্ঠী বাস্তুহারা হয়ে পড়ে ও খাদ্যের ব্যপক সংকট দেখা দেয়।

    ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব রণাঙ্গনে সামরিক হতাহত[১৫১]
    অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধরত বাহিনী
    মোট নিহতনিহত/ক্ষত থেকে মৃত্যু/নিখোঁজসোভিয়েতদের হাতে বন্দীবন্দী অবস্থায় মৃতআহত (ক্ষত থেকে মৃত নয় এমন)
    বৃহত্তর জার্মানি৪১,৩৭,০০০ (সম্ভাব্য)[১৫২]৩৬,৩৭,০০০ (সম্ভাব্য)২৭,৩৩,৭৩৯-৩০,০০,০৬০৫,০০,০০০[১৫৩]অজানা
    সোভিয়েত বাসিন্দা যারা জার্মান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল২,১৫,০০০২,১৫,০০০৪,০০,০০০+অজানা১,১৮,১২৭
    রোমানিয়া২,৮১,০০০২,২৬,০০০৫,০০,০০০৫৫,০০০
    হাঙ্গেরি৩,০০,০০০২,৪৫,০০০৫,০০,০০০৫৫,০০০৮৯,৩১৩
    ইতালি৮২,০০০৫৫,০০০৭০,০০০২৭,০০০
    ফিনল্যান্ড[১৫৪]৬৩,২০৪৬২,৭৩১৩,৫০০৪৭৩১,৫৮,০০০
    মোট৫০,৭৮,০০০ (সম্ভাব্য)৪৪,৩৭,৪০০ (সম্ভাব্য)৪২,৬৪,৪৯৭-৪৫,৩০,৮১৮৬,৩৭,০০০ (সম্ভাব্য)অজানা
    ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব রণাঙ্গনে সামরিক হতাহত[১৫৫]
    সোভিয়েত ইউনিয়নে যুদ্ধরত বাহিনীসমূহ
    মোট নিহতনিহত/ক্ষত থেকে মৃত্যু/নিখোঁজঅক্ষশক্তির হাতে যুদ্ধবন্দীবন্দী অবস্থায় মৃতআহত (ক্ষত থেকে মৃত নয় এমন)
    সোভিয়েত৮৬,৬৮,৪০০-১,০০,০০,০০০৬৮,২৯,৬০০৪০,৫৯,০০০(শুধুমাত্র সামরিক ব্যক্তি)–৫৭,০০,০০০২২,৫০,০০০-৩৩,০০,০০০[১৫৬][১৫৭] of which 1,283,200 confirmed[১৫৮]১,৩৫,৮১,৪৮৩[১৫৯]
    পোল্যান্ড২৪,০০০২৪,০০০অজানাঅজানা
    রোমানিয়া১৭,০০০১৭,০০০৮০,০০০অজানা
    বুলগেরিয়া১০,০০০১০,০০০অজানাঅজানা
    মোট৮৭,১৯,০০০-১,০০,০০,০০০ পর্যন্ত৬৮,৮০,৬০০৪১,৩৯,০০০-৫৭,৮০,০০০২২,৫০,০০০-৩৩,০০,০০০১,৩৫,৮১,৪৮৩
    এস্তোনিয়াতে একটি জার্মান যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র।

    সোভিয়েত তথ্যসূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ক্রিভোশিভের মতে, ১৯৪১-১৯৪৫ সালের মধ্যে পূর্ব রণাঙ্গনে জার্মান হতাহতের সংখ্যা ৬৯,২৩,৭০০ জন: যার অন্তর্ভুক্ত যুদ্ধে নিহত সৈন্য, ক্ষত ও রোগ-বালাই থেকে মৃত। নিখোঁজ ও মৃত ধারণা করা হয় এমন ব্যক্তিবর্গের সংখ্যা ৪১,৩৭,১০০ জন। যুদ্ধবন্দী ২৫,৭১,৬০০ জন এবং জার্মান বাহিনীতে যুদ্ধরত রুশ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মৃত: ২,১৫,০০০। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে নিহত: ৪,৫০,০০০ জন, যার মধ্যে এন.কে.ভি.ডি. শিবিরে মৃত ৩,৫৬,৭০০ জন এবং যাত্রাপথে মৃত ৯৩,৯০০ জন।[১৫২]

    ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত এক হিসাব মতে, পূর্ব রণাঙ্গনে ২২শে জুন, ১৯৪১ থেকে নভেম্বর, ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত মালামালের ক্ষয়ক্ষতি এরূপ: ৩৩,৩২৪টি যুদ্ধযান বিধ্বস্ত (এর মধ্যে রয়েছে ট্যাংক, ট্যাংক-বিধ্বংসী যান, কামান, চলমান কামান এবং অন্যান্য যান)। "হিটলারকে পরাস্ত করা" ("Defeating Hitler") গ্রন্থে লেখক পল উইন্টার লেখেন, "এই প্রদত্ত সংখ্যাসমূহ নিঃসন্দেহে অতি স্বল্প।"[১৬০] সোভিয়েতদের দাবি মতে পূর্ব রণাঙ্গনে জার্মানদের ক্ষয়ক্ষতি: ৪২,৭০০টি ট্যাংক, ট্যাংক বিধ্বংসী যান, চলমান কামান এবং আক্রমণ কামান।[১৬১] বস্তুত জার্মানদের নির্মিত যুদ্ধযানের সংখ্যা এরূপ: ৩,০২৪টি অনুসন্ধান (reconnaissance) যান, ২,৪৫০টি ট্যাংক ও এজাতীয় যান, ২১,৮৮০টি বর্ম-আচ্ছাদিত সেনা পরিবহন যান (Armoured personnel carrier), ৩৬,৭০৩টি অর্ধ-ট্র্যাকযুক্ত ট্রাক্টর এবং ৮৭,৩২৯টি অর্ধ-ট্র্যাকযুক্ত ট্রাক,[১৬২] ধারণা করা হয় এসবকিছুর দুই-তৃতীয়াংশ পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধক্ষেত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

    সোভিয়েতরা হারায় ৯৬,৫০০টি ট্যাংক, ট্যাংক বিধ্বংসী, চলমান কামান ও আক্রমণ কামান। এছাড়াও ৩৭,৬০০টি অন্যান্য যুদ্ধযান (যেমন বর্ম-আচ্ছাদিত গাড়ি ও অর্ধ-ট্র্যাকযুক্ত ট্রাক), তাদের মোট যুদ্ধযান ধ্বংস হয় ১,৩৪,১০০টি।[১৬৩]

    এছাড়াও সোভিয়েতদের ১,০২,৬০০টি বিমান বিধ্বস্ত হয় (যুদ্ধ-বিমান ও অন্যান্য বিমানসহ), যার মধ্যে ৪৬,১০০টি যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়।[১৬৪] সোভিয়েতদের দাবি পূর্ব রণাঙ্গনে জার্মানদের ৭৫,৭০০টি বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল।[১৬৫]

    পূর্বে পোলিশ সামরিক বাহিনী ১৯৪৩ সাল থেকে লাল ফৌজের পাশাপাশি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, এবং ১৯৪৪-৪৫ সালে নাৎসিদের থেকে পোলিশ ভূমি স্বাধীন হতে থাকলে তাদের বাহিনীর আকারও বৃদ্ধি পায়।

    রাশিয়ার খোল্‌মে নিহত সোভিয়েত সৈন্যগণ, জানুয়ারি, ১৯৪২।

    কেন্দ্রীয় ইউরোপের অক্ষশক্তির সদস্য রাষ্ট্রসমূহ যখন সোভিয়েত বাহিনী কর্তৃক দখল হয়, তারা পক্ষ পরিবর্তন করে ফেলে এবং জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

    কতিপয় সোভিয়েত নাগরিক যুদ্ধে জার্মানদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং আন্দ্রেই ভ্লাসভের নেতৃত্বে "রুশ স্বাধীনতা বাহিনী"-তে যোগদান করে। এ বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিল রুশ যুদ্ধবন্দী। এদের অধিকাংশকে পূর্ব রণাঙ্গনে ব্যবহার করা হয়, তবে কিছু অংশকে নরম্যান্ডি উপকূল রক্ষায় নিয়োজিত করা হয়।[১৬৬] জার্মান বাহিনীতে যোগদান করা অন্যান্যদের মধ্যে ছিল বাল্টিক রাষ্ট্রসমূহের নাগরিকগণ, যাদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪০ সালে জোরপূর্বক দখল করেছিল। এছাড়াও পশ্চিম ইউক্রেনের অনেক নাগরিক জার্মানদের পক্ষ অবলম্বন করে। তারা তাদের নিজস্ব "ওয়াফেন-এস.এস." বাহিনী গঠন করে।[১৬৭]

    হিটলারের কুখ্যাত "কমিসার আদেশ"-এ বলা হয়, যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে সোভিয়েত রাজনৈতিক অফিসার বা কমিসারদেরকে চিহ্নিত করে নির্বিচারে হত্যা করা। এই কমিসারদের দায়িত্ব ছিল লাল ফৌজ সদস্যদের রাজনৈতিক আনুগত্য নিশ্চিত করা। লাল ফৌজের যেসকল সৈন্য অক্ষশক্তির সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ত তাদের অধিকাংশকেই দেখামাত্র গুলি করা হত, অথবা যুদ্ধবন্দী শিবিরসমূহে পাঠিয়ে দেয়া হত, যেখানে তাদেরকে জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা হত কিংবা হত্যা করা হত।[১৬৮] এছাড়াও লক্ষ লক্ষ সোভিয়েত বেসামরিক নাগরিককেও যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করা হত এবং তাদের সঙ্গেও একই আচরণ করা হত। অনুমান করা হয়, নাৎসিদের হাতে বন্দী মোট ৫২.৫-৫৭ লক্ষ সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীর মাঝে ২২.৫ থেকে ৩৩ লক্ষ যুদ্ধবন্দীই নিহত হয় (মোট বন্দীর ৪৫-৫৭%)। তুলনামূলকভাবে, ব্রিটিশ ও মার্কিন যুদ্ধবন্দীর সংখ্যা ছিল ২,৩১,০০০ জন, যার মধ্যে ৮,৩০০ জন নিহত (মোটের ৩.৬%)।[১৬৯][১৭০] নিহত সোভিয়েত বন্দীদের মধ্যে ৫% ছিল ইহুদি।

    আরও দেখুনসম্পাদনা

    তথ্যসূত্রসম্পাদনা

    এসম্পর্কিত পাঠ্যসমূহসম্পাদনা

    ঐতিহাসিক রচনাশৈলীসম্পাদনা

    বহিঃসংযোগসম্পাদনা

    ভিডিওসম্পাদনা

    • "Operation Typhoon": ইউটিউবে ভিডিও, lecture by David Stahel, author of Operation Typhoon. Hitler's March on Moscow (2013) and The Battle for Moscow (2015); via the official channel of USS Silversides Museum.
    • "Fighting a Lost War: The German Army in 1943": ইউটিউবে ভিডিও, lecture by Robert Citino, via the official channel of the U.S. Army Heritage and Education Center.
    • "Kursk, The Epic Armored Engagement": ইউটিউবে ভিডিও, via the official channel of The National WWII Museum; session by the Robert Citino and Jonathan Parshall at the 2013 International Conference on World War II.
    • "Mindset of WWII German Soldiers": ইউটিউবে ভিডিও—interview with the historian Sönke Neitzel discussing his book Soldaten: On Fighting, Killing and Dying, via the official channel of The Agenda, a programme of TVOntario, a Canadian public television station.
    • "How the Red Army Defeated Germany: The Three Alibis": ইউটিউবে ভিডিও—lecture by Jonathan M. House of the U.S. Army Command and General Staff College, via the official channel of Dole Institute of Politics.
    🔥 Top keywords: প্রধান পাতাবিশেষ:অনুসন্ধানইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগবদরের যুদ্ধআনন্দবাজার পত্রিকাবাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসআর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলইসলামবাংলাদেশব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলদোয়া কুনুতফিফা বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংএক্স এক্স এক্স এক্স (অ্যালবাম)বাংলা ভাষাআবহাওয়াআর্জেন্টিনাআর্জেন্টিনা–ব্রাজিল ফুটবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাশেখ মুজিবুর রহমানমিয়া খলিফাকোস্টা রিকা জাতীয় ফুটবল দলরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরমুম্বই ইন্ডিয়ান্সবিশেষ:সাম্প্রতিক পরিবর্তনসমূহযাকাতলিওনেল মেসিফিতরামুহাম্মাদইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউনকুরআনের সূরাসমূহের তালিকাবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলক্লিওপেট্রাচেক প্রজাতন্ত্রইউটিউবকাজী নজরুল ইসলামদোলযাত্রাআসসালামু আলাইকুমবাংলা প্রবাদ-প্রবচনের তালিকাশিয়া ইসলামচেন্নাই সুপার কিংসকুরআনবিকাশআয়াতুল কুরসিমৌলিক পদার্থের তালিকাবাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধছয় দফা আন্দোলনশাকিব খানসানরাইজার্স হায়দ্রাবাদভুটানসৌদি আরবআল্লাহর ৯৯টি নাম২০২৪ কোপা আমেরিকাবিশ্ব থিয়েটার দিবসবাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের তালিকাপহেলা বৈশাখসেজদার আয়াতভারতপদ্মা সেতুদৈনিক প্রথম আলোঢাকা মেট্রোরেলভূমি পরিমাপশেখ হাসিনাবাংলাদেশে পালিত দিবসসমূহওয়ালাইকুমুস-সালামভৌগোলিক নির্দেশকবদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবাদের তালিকাযৌনসঙ্গমবাংলাদেশী টাকাইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিকম্পিউটারহজ্জটুয়েন্টি২০ আন্তর্জাতিকের রেকর্ড তালিকাবাংলা বাগধারার তালিকানেপোলিয়ন বোনাপার্টবাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের তালিকাবিভিন্ন দেশের মুদ্রাটেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাবাংলা ভাষা আন্দোলন২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব২৭ মার্চজনি সিন্সবাংলাদেশের জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২সাহাবিদের তালিকাঅকাল বীর্যপাত২০২৩ট্রাভিস হেডন্যাটোমুহাম্মাদের স্ত্রীগণলিঙ্গ উত্থান ত্রুটিমাইকেল মধুসূদন দত্তজানাজার নামাজব্রাজিলমহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলবসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রডুগংমুস্তাফিজুর রহমানবাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রীপশ্চিমবঙ্গফরাসি বিপ্লব